বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি ও স্ট্রাকচারাল রিফর্মস প্রোগ্রামের মধ্যে শর্ত আরোপ করে তা বাস্তবায়নে চাপ দিচ্ছে। বিগত পাঁচ দশকে অনেক বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে সাফল্য ছিল বা এসেছে সেসব উন্নয়ন ও সাফল্যকে টেকসই ও অর্থনীতিতে তার স্থায়ী অধিষ্ঠান ও অগ্রগতি সহগামী হতে বারবার হোঁচট খেয়েছে বা খাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। যার মুখ্য শনাক্তযোগ্য কারণ সুশাসন, সদাচরণের অভাব, দূরত্ব পরস্পরের মধ্যে সেবক ও সেবাগ্রহীতার, চিন্তা-চেতনার, চাহিদা ও সরবরাহের, স্বপ্ন ও সত্যের, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির।
জুলাই গণজাগরণের পর এই সমাজে রাজনীতিতে অর্থনীতিতে সুস্থ পথে ওঠার সংগ্রামের এই পর্যায়ে সবার মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বেশ কয়েক মাস স্থবির হয়ে পড়ে থাকা ব্যক্তি-পরিবার সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় জীবন ও জীবিকায় সমন্বয় সাধনের অনিবার্যতা উপস্থিত। কিন্তু আত্মসচেতনতা, দেশিক মূল্যবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে অগ্রগতি চাহিদা অনুযায়ী বাড়লেও তা স্থিতিশীল তথা টেকসইকরণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বড় বৈসাদৃশ্য ও বেমানান বাড়াবাড়িতে রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির দৈন্য ও দুর্দশা ফুটে উঠেছে। সরবরাহ ও চাহিদার এই মহামহিম দূরত্বের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীরও দাম হু হু করে বাড়ে, ধৈর্যে, সমস্যা সমাধানে একাগ্রতায়, ঐকমত্যে চিড় ধরে। এ অবস্থায় সমাজে আর্থিক বৈষম্যের বিবর আরো বেদনাদায়কভাবে উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশ অর্থনীতির চালচিত্র, এর আবহমান সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ-আন্দোলন অভ্যুত্থান-উত্তর পরিবেশে ভেদাভেদ ভুলে পুরনো দিনের বেদনা ও বৈষম্যের জঞ্জাল সরিয়ে সামনের নতুন সময়ে যেন গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ও পরিতৃপ্তি উপভোগ করার চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক না হয় পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির, ধর্ষণ ও প্রতারণা, সামাজিক অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি নানান খাত ও ক্ষেত্রে অতি অস্বাভাবিক আচরণে প্রকারান্তরে স্বৈরাচারী সম্মোহিত সময়কে ওয়াকওভার দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
প্রভূত পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও পটভূমিতে আজ এটি স্পষ্ট হচ্ছে যে, দূরত্ব আরো বাড়ছে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ও নাগরিকের মধ্যে, করদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে, শিল্পমালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, নীতিনির্ধারকের সাথে পোষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, উৎপাদনকারীর সাথে খুচরা ক্রেতার, ব্যাংকের আমানতকারীদের সাথে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশার সাথে আর্থিক খরচে কর্মনৈপুণ্যের, ব্যয় সঙ্কোচন কৃচ্ছ্রতা সাধন পরিবেশেও বলগাহীন ব্যয়ের, সদাচার, সামাজিক ন্যায়নীতি-নির্ভরতার সাথে অসদাচার ও নীতিহীনতার, সুশৃঙ্খলা বোধের সাথে উচ্ছৃঙ্খলতার, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সাথে ব্যয় ব্যবস্থাপনার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সাথে সাধারণ মানুষের। সামষ্টিক অর্থনীতিতে চড়া সুদ ও কড়া শর্তের ঋণের টাকা প্রাপ্তি ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে অসচেতন অমিতব্যয়িতার ডামাডোলকে মনে হতেই পারে এটি পুঁজিবাদী মানসিকতা প্রস্তুত এবং বৈষম্যবিলাসী উদাসীন ঊর্ধ্বতনদের ইচ্ছা ও অভিলাষ উৎসারিত। এই অগ্রগতি গুণগত মানোন্নয়ন ব্যতিরেকে পরীক্ষা না দিয়েই শিক্ষার পাসের হার বৃদ্ধিকে সাময়িক বিজয় ও তৃপ্তি লাভের অগ্রগতি মনে হতে পারে। ভূত-ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে নয়- সাময়িকভাবে, নিজেদের মতো করে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সীমিতভাবে সীমাবদ্ধকরণের প্রয়াস উৎসারিত হওয়া উচিত ছিল। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী যেখানে একটি স্বাধীন সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু, সেখানে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতি-নির্ভরতা, নৈতিক মনোবল ও মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতিকে আপাত প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসাকে নানান অজুহাত অবয়বে নিরুৎসাহিত করা চলে না। সেগুলো ক্রমেই নির্বাসনে পাঠিয়ে সাময়িক এই প্রগলভতায় সমাজ ও রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে এগোচ্ছে না পিছিয়ে যাচ্ছে তার একটি সালতামামি ও আত্ম-বিশ্লেষণ সবসময়ই প্রয়োজন।
মূলত এবং মুখ্যত নব্বইয়ের দশকেই বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণে ঊর্ধ্বমুখী অগ্রযাত্রা শুরু। ১৯৯১-এর শুরুতে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। বাংলাদেশে ট্রেডিংনির্ভরতা থেকে উৎপাদনমুখী অর্থনীতির নবযাত্রা শুরু হয় সেখান থেকেই। প্রথম বছরেই মূল্য সংযোজন কর আইন প্রবর্তিত হয়। ’৯২ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লোকবল ও কর্মকাঠামোয় প্রথম সম্প্রসারণ ও সংস্কার আনা হয়। সে সময় বাংলাদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন উদ্যম, নতুন উদ্যোগ সংযোজিত হওয়ায় অর্থনৈতিক খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটে, এ দশকেই তিনবার (১৯৯২, ১৯৯৬ ও ১৯৯৯) ঘোষিত হয় সংশোধিত শিল্পনীতি। ১৯৯৩ সালে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন, প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড প্রতিষ্ঠা, সাউথ এশিয়ান প্রিফারেনসিয়াল ট্রেড অ্যারেঞ্জমেন্ট (সাফটা) চুক্তি স্বাক্ষরিত এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যাক্ট পাস হয়। ১৯৯৪ সালে প্রথম সেলুলার ফোন পদ্ধতি চালু, ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইন প্রথম সংশোধন, টাকাকে চলতি হিসাবে লেনদেনের জন্য রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অর্থতহবিলের ৮ নং আর্টিকেলের মর্যাদা লাভ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে আইন ও বিধিমালা জারি হয়। ১৯৯৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিস বাংলাদেশ (আইসিসিবি) গঠিত হয় এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ চালু হয়। ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে পাওয়ার সেল গঠন, গ্রাসাধার বিধিমালা জারি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রাইভেট এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন আইন পাস, প্রাইভেট পাওয়ার জেনারেশন পলিসি ঘোষণা।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে ব্যবসায়-বাণিজ্য বিনিয়োগ উৎপাদন তথা আর্থিক খাতে যুগোপযোগী আইন প্রবর্তন, নীতি-নিয়ম-পদ্ধতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধিত হওয়ার ফলে রাজস্ব আহরণের উপায় উন্নতি দৃশ্যগ্রাহ্য হয়। মূসক আইন প্রবর্তনসহ বেশ কয়েকটি রেগুলেটরি সংস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে কর রাজস্ব আহরণের প্রকৃতি বিস্তৃত হয় ও সার্বিক রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। প্রসঙ্গত, তখন পর্যন্ত শুধু আমদানি শুল্কই ছিল রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তনের ফলে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও বিপণন এবং আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্পূরকসহ শুল্ক হিসাবায়ন ও আদায় অভিযাত্রায় একটি গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয় এবং উঠে আসে ভোক্তা কর্তৃক প্রদত্ত পরোক্ষ (পণ্য ও সেবা) কর হিসাব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধির তাগিদ। তবে প্রথম দিকে এ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে এবং করদাতা ও আহরণকারী উভয় পক্ষের মধ্যে নানান অনুযোগ অজুহাতে এক ধরনের ‘সময় নেয়ার’ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অর্থনীতি যখন সবে বড় হতে শুরু করেছে সে সময় নতুন ভ্যাট আইন হঠাৎ করে কিছুটা হলেও গোলকধাঁধার পরিবেশ সৃষ্টির দ্যোতক হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে এর গ্রহণ ও প্রয়োগ যোগ্যতায় আনা হয় সংস্কার। ২০১২ সালে (কথিত) নতুন ভ্যাট আইনটি পার্লামেন্টে নতুন মোড়কে পাস করা হলেও, ১৯৯১ সালের মতো ব্যবসায়ীদের অব্যাহত অনুযোগ অজুহাত এবং যা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণের দীর্ঘসূত্রতায়, সর্বোপরি এ আইন বাস্তবায়নে দৃঢ়সংকল্প রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপ্রতুলতায় এটি প্রবর্তিত হতে লাগে দীর্ঘ ৯ বছর। এখনো বোঝা যাচ্ছে না এনবিআরের অনলাইন কার্যক্রমের হালহকিকত।
বাংলাদেশের রাজস্বব্যবস্থা একটি স্বয়ংক্রিয় ও যুক্তিযুক্ত ভিত্তি প্রক্রিয়ার ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গঠনমূলক বেশ কিছু উদ্যোগ গৃহীত হলেও পরবর্তীকালে সে সব প্রয়াস প্রচেষ্টায় যথাযথ ফলোআপ অতি আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি করা হলে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রাজস্ব আহরণের আওতায় আনতে বেগ পেতে হবে না; শুধু তাই নয় এখানকার বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে নিষ্কৃতিও মিলবে। আমদানি পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ ও শুল্কায়নের স্বার্থে বিদেশী ভেন্ডরদের বাংলাদেশে এই কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং তাদের কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ও অনিয়ম যুগলবন্দি হয়ে ওঠায় দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতির মহড়া দেখা যায়। এনবিআরের লোকবল ও কর্মপদ্ধতির উন্নয়ন অভীপ্সায় বিশেষ করে ভ্যালুয়েশন এবং শুল্কায়নে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রয়োগের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং ডিএফআইডির অর্থায়নে বেশ কয়েকটি গুচ্ছ প্রকল্প (যেমন- কাস্টমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মডার্নাইজেশন বা ক্যাম; এক্সাইজ, কাস্টমস, ট্যাক্সেশন-ইটাক, ডাটা কম্পিউটারাইজেশন) বাস্তবায়নের মহড়া এখনো চলছে। আগের প্রকল্পগুলোর মেয়াদান্তে তাদের রেখে যাওয়া সুপারিশ, প্রবর্তিত পদ্ধতি সফটওয়্যার প্রয়োগ বাস্তবায়ন ফলাবর্তনে সবসময় সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়নি। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি ও স্ট্রাকচারাল রিফর্মস প্রোগ্রামের মধ্যে শর্ত আরোপ করে তা বাস্তবায়নে চাপ দিচ্ছে।
বিগত পাঁচ দশকে অনেক বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে সাফল্য ছিল বা এসেছে সেসব উন্নয়ন ও সাফল্যকে টেকসই ও অর্থনীতিতে তার স্থায়ী অধিষ্ঠান ও অগ্রগতি সহগামী হতে বারবার হোঁচট খেয়েছে বা খাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। যার মুখ্য শনাক্তযোগ্য কারণ সুশাসন, সদাচরণের অভাব, দূরত্ব পরস্পরের মধ্যে সেবক ও সেবাগ্রহীতার, চিন্তা-চেতনার, চাহিদা ও সরবরাহের, স্বপ্ন ও সত্যের, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির।
লেখক : সাবেক সচিব
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
https://www.dailynayadiganta.com/printed-edition/VLL3qjIVa4cU/