১৭ মার্চ ২০২৫, সোমবার

চার বছরে ৭ হাজার শিশুসহ ৪৩ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিক সেঞ্চুরি করেছিলেন ধর্ষণের। শুধু তাই নয়, তার একশতম ধর্ষণ উদযাপন উপলক্ষে দিয়েছিলেন বিশাল ককটেল পার্টি। মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে দম্পত্তিকে ডেকে এনে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছিল দুই ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ও মামুন। সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রবাসে স্বামীকে বেঁধে তার সামনে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করেছিলো ছাত্রলীগ। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন তনু। বরিশালের বানারীপাড়ায় মা-মেয়েকে এক সাথে ধর্ষণ করা হয়। শুধু তাই নয়, উল্টো ধর্ষিতাদের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছিল প্রভাবশালী ধর্ষক তুফান। ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে নারীদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে দেশের অনেক জায়গায়।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের শেষ চার বছরে সাত হাজার শিশুসহ প্রায় ৪৩ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক লাখ ৩৭ হাজার নারী। সে সময় ছাত্রবাস থেকে রাজপথ, অজোপাড়া গাঁ থেকে মফস্বল- কোথাও বাদ ছিল না ধর্ষকদের বিচরণ।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে শহবাগে আয়োজিত বিক্ষোভের সাথে আমরা একমত। সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এর আগে যে হাজার হাজার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল সে সময় কোথায় ছিলেন তথাকথিত লাকী আক্তাররা? ওইসব ঘটনার সময় লাকীদের শাহবাগ উত্তাল করতে দেখা যায়নি কেন? নাকি আগেরগুলো তারা ধর্ষণ মনে করেননি? নাকি কি লাকী আক্তাররা শুধু কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নেই মাঠে নামেন।
এমন অভিযোগ করছেন ধর্ষণের শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী নারী। তারা বলছেন, সঠিক বিচার না পেলে আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ নেই। কিন্তু একপেশে আন্দোলন কেন? শুধু ভুক্তভোগীরাই নয়, এমসি কলেজে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় নারী নেত্রীদের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন হাইকোর্ট।

পুলিশ সদর দফতরের এক তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশের ধর্ষণের ঘটনাগুলো ছিল উদ্বেগজনক। এই সময়ে সারা দেশে ধর্ষণের ৩৪ হাজার ৪৭০টি মামলা দায়ের হয়েছে। এ সময় থানায় করা মামলার মধ্যে পুলিশ ছয় হাজার ১০০টি মামলা তদন্ত শেষে ৯ হাজার দু’জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে। অন্য সব মামলার তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, শুধু ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনায় ছয় হাজার ১১৪টি মামলা হয়েছে। ২০২০ সালে করোনার বছরেও সাত হাজার ১৯৪টি, ২১ সালে ছয় হাজার ৯৮৬টি, ২২ সালে সাত হাজার ১২টি, ২৩ সালে ছয় হাজার ২৩২টি এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৩০৭টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৫১টি ও মার্চ মাসে ৩৭৩টি ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে। গত ছয় বছর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের পাশাপাশি নারী নির্যাতনের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৭১টি। যৌতুক না পেয়ে ও ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ১৫৯ জন নারী। শুধু ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষনের অভিযোগ আসে চার হাজার ৩৩১টি। আগস্টে সব থেকে কম মামলা দায়ের হয়েছে।

অথচ খোঁজ নিয়ে দেখে গেছে, পুলিশ সদরদফতরের তথ্যের সাথে মহিলা পরিষদের তথ্যের বিস্তর অমিল রয়েছে। পুলিশ সদর দফতর বলছে, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় থানাগুলোতে মামলা হয়েছে ১৯ সালে ২১ হাজার ৭৬৪টি, ২০ সালে ২২ হাজার ৫১৭টি, ২১ সালে ২২ হাজার ১৩৬টি, ২২ সালে ২১ হাজার ৭৬৬টি এবং ২০২৩ সালে ১৮ হাজার ৯৪১টি। অন্য দিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে, ২০১৮ সালে এক হাজার সাতজন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১৯ সালে এক হাজার ৭৮৪ জন, ২১ সালে তিন হাজার ৭০৩ জন, ২২ সালে ৯৮৭ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরে ৩৮ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। ২০২৩ সালে দুই হাজার ৯৩৭টি নির্যাতনের মধ্যে ৬৩৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

সূত্র জানায়, ধর্ষণের সেঞ্চুরি করার আনন্দে মানিকের পার্টি দেয়া মিষ্টি বিতরণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ওই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা দীর্ঘ দিন তদন্তের পরে মানিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের প্রমাণ পায়। এরপর ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। ঘটনার পর পালিয়ে যায় মানিক। কেউ বলছে ঘটনার পর ইতালি গিয়ে মৃত্যু হয় মানিকের। তবে এর সত্যতা এখনো পাওয়া যায়নি। সেখানে তাকেসহ তার দলের কয়েকজনকে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার সাথেই জড়িত ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের সহযোগী দলের সদস্যরা। এমনকি সম্প্রতি মাগুরায় শিশু আছিয়ার ধর্ষণকারীরাও ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক। বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের প্রতিটি মিছিল সভা-সমাবেশে উপস্থিত থেকেছে তারা।

তবে ধর্ষণের ব্যপারে কঠিন অবস্থানে থাকার পাশাপাশি জনসচেতনাতার কাজ করছে পুলিশ। পুলিশ সদর দফতরের এইআইজি (মিডিয়া) এনামুর রহমান সাগর নয়া দিগন্তকে বলেন, ধর্ষণ মামলার কার্যক্রমগুলো দ্রুত তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশনা হয়েছে, যাতে অপরাধী কঠোর শাস্তির পায়। একই সাথে ধর্ষণরোধে মাঠ পর্যায়ে জনসচেতনতার জন্যও কাজ করছে, যাতে মানুষের মধ্যে ধর্ষণবিরোধী মনোভব জাগ্রত হয়। সাগর আরো বলেন, ধর্ষণরোধে শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার থেকেও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/printed-edition/A0BBBDcgFPKD/