৮ মার্চ ২০২৫, শনিবার

ইফা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিকৃতি আওয়ামী সরকারের

দেশের একমাত্র সরকারি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে বিগত ১৫ বছরে ‘মুজিবীকরণে’ ওঠেপড়ে লেগেছিল আওয়ামী সরকার। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাসই বিকৃত করে ফেলা হয়। হঠাৎ সব স্থাপনা ও বইপত্রে যুক্ত করা হয়, ‘শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা।’

একইভাবে প্রতিষ্ঠানটির মৌলিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে গিয়ে দলীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর ছিলেন তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা। ইমাম প্রশিক্ষণে ‘ব্যালে ড্যান্সের’ মতো অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড চালায় প্রতিষ্ঠানটি। এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছেন, তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে।

৫ আগস্ট-পরবর্তী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে সব স্থাপনা ও কাগজপত্র থেকে তথাকথিত প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বর্তমান প্রশাসন।

সূত্র জানিয়েছে, গত ১৫ বছরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। সব কার্যালয়ের সাইনবোর্ড এবং দাপ্তরিক কাগজপত্র ও প্রকাশিত বইয়ে যুক্ত করা হয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিযুক্ত মহাপরিচালক (ডিজি) সামীম মোহাম্মদ আফজালের (মৃত) উদ্যোগে প্রতিষ্ঠাতার এই নাম প্রচার করা হয়, যা সঠিক নয় বলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এ কারণে ৫ আগস্টের পর প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড অব গভর্নরসের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শেখ মুজিবের নাম সরানো হয়েছে।

এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বর্তমান মহাপরিচালক আ. ছালাম খান আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী সরকারের সময়ে সাবেক ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শেখ মুজিবের নাম প্রস্তাব করলে সরকার সেটি অনুমোদন দেয়।

আমরা প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব পাওয়ার পর বোর্ড অব গভর্নরসের সভায় প্রতিষ্ঠাতার নাম মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী, সব স্থাপনা থেকে মুজিবের নাম মুছে ফেলা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের যেসব বইয়ে এই নাম আছে, যথাসম্ভব তাতে লেবেল লাগিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। নতুন কোনো বইয়ে এটি ছাপা হবে না।
সূত্র অনুসারে, ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রচার এবং ইসলামি কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা। ১৯৫৯ সালে ঢাকায় একটি বৃহৎ মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘বায়তুল মোকাররম সোসাইটি’ নামে একটি সমিতি গঠন করা হয়।
একই বছর ঢাকার কয়েকজন ইসলামি চিন্তাবিদ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে ইসলামি জীবনাদর্শের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গবেষণা এবং ইসলামি সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘দারুল উলুম’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর ‘ইসলামী একাডেমি’ নামে এর নতুন নামকরণ করে করাচিতে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের শাখারূপে এটাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ইসলামী একাডেমি প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রাখেন আল্লামা আবুল হাশিম (প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক)। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইসলামী একাডেমির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসে ইসলামী একাডেমি তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি।

পরবর্তী সময়ে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশসহ কিছু আলেমের প্রচেষ্টায় শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ ‘বায়তুল মোকাররম সোসাইটি’ এবং ‘ইসলামী একাডেমি’ একীভূত করে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেন। যা ২৮ মার্চ ১৯৭৫ সালে আইনে পরিণত হয়।

আইন তৈরি হলেও ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা অস্তিত্ব ছিল না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বায়তুল মোকাররম সোসাইটি ও ইসলামী একাডেমিকে একীভূত করে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।

১৯৭৮ সালের ২০-২২ মার্চ বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে ঢাকায় ওআইসির উদ্যোগে ‘হিউম্যান অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস ইন দ্য ইসলামিক কান্ট্রিস’ শীর্ষক যে সেমিনার হয়, তার মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মুসলিম বিশ্বের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯-৮০ অর্থবছর থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অগ্রযাত্রায় বিশেষ গতি সঞ্চার হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায় ছিল বিগত আওয়ামী সরকারের টানা ক্ষমতার প্রথম ১১ বছর। বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এমন কোনো অপকর্ম নেই যা ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ঘটেনি। জেলা ও দায়রা জজ সামীম মোহাম্মদ আফজাল ডিজি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে এই ১১ বছরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মৌলিক কাঠামো নষ্ট করে ফেলেন।
ইমামদের সামনে ব্যালে নৃত্য, কাঙালিনী সুফিয়ার গান, আবুল বারাকাতের সহযোগিতায় ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত, অনিয়ম, দুর্নীতি, জাল জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ-পদোন্নতি, ইসলামি প্রকাশনা, গবেষণা, বিশ্বকোষ ও অনুবাদ কার্যক্রমকে ধ্বংস করা, সর্বক্ষেত্রে প্রখ্যাত আলেম-ওলামাকে বাদ দিয়ে দরবারি ও মাজারপূজারি আলেমদের জয়জয়কার, দলীয় প্রচার প্রচারণা-সবই হয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে।

প্রতিষ্ঠানটি মূল প্রকাশনার পরিবর্তে মুজিবের নামে প্রচার-প্রসারে তৎপর ছিল। মডেল মসজিদ নির্মাণের মতো কিছু ভালো উদ্যোগের কথা প্রচার করা হলেও তার পেছনে যে অঢেল দুর্নীতি হয়েছে সে বিষয়ে চুপ থেকেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া কর্তাব্যক্তিরা।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে সামীম আফজালের অপকর্মের বিরুদ্ধে আলেম-ওলামাদের মধ্যে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হলেও তা আমলে নেয়নি তৎকালীন সরকার। বরং প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নেয় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। ডিজির মতের বাইরে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যখন-তখন বদলিসহ নানা হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, ঢাকার আগারগাঁওয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয় ছাড়াও বায়তুল মোকাররমের অফিসে প্রধান কার্যালয়ের কয়েকটি বিভাগীয় কার্যালয় রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয়ভাবে ১৭টি বিভাগ, ৭টি প্রকল্প, ১টি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, মাঠপর্যায়ে ৮টি বিভাগীয়সহ ৬৪টি জেলা কার্যালয় এবং আর্তমানবতার সেবায় ৫০টি ইসলামিক মিশন কেন্দ্র, ৭টি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিসহ সারাদেশে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

https://dailyamardesh.com/religion-islam/amdbcre2e9bby