৫ মার্চ ২০২৫, বুধবার

সংস্কার আর মেরামতের নামে লুটপাটের মহোৎসব

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল দেশের অন্যতম ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানা।

আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে কারখানা বন্ধ রাখা, নিম্নমানের দ্রব্য ক্রয় আর যন্ত্রাংশ সংস্কারের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

এছাড়া গ্যাস সংকট ও যান্ত্রিক ক্রটির কারণে প্রায়ই বন্ধ থাকছে সার কারখানার উৎপাদন। ফলে লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি এখন পরিণত হয়েছে রুগ্‌ণ প্রতিষ্ঠানে। প্রতিবার কারখানাটি বন্ধ থেকে চালু করার পর সংস্কার ও মেরামতের নামে চলে সরকারি অর্থ লোপাট।

উৎপাদন শুরুর মাত্র ৩৮ দিনের মাথায় আবারও গ্যাস সংকটে আশুগঞ্জ সার কারখানায় বন্ধ হয়ে গেছে ইউরিয়া উৎপাদন। এর আগে ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় সার উৎপাদন বন্ধ থাকে।

পরবর্তীতে শ্রমিকদের দীর্ঘ আন্দোলনের পর ওই বছরের ১৫ নভেম্বর গ্যাস সরবরাহ শুরু হলে ২০২৫ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে সার উৎপাদন শুরু হয়। তবে শনিবার থেকে আবারও তা বন্ধ হয়ে যায়।

জানা যায়, ১৯৮১ সালে আশুগঞ্জ উপজেলার চরচারতলা এলাকার মেঘনা নদীর পাশে ৫৩৬.১৩ একর জায়গা নিয়ে স্থাপিত হয়েছিল আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে ইউরিয়া সার উৎপাদন শুরু করে কারখানাটি। এরপর ১৯৮৩ সালের ১ জুলাই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়।

কারখানাটিতে উৎপাদিত সার কমান্ডভুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার (কিছু অংশ) ডিলারদের কাছে সরবরাহ করা হয়। দৈনিক ১৬০০ টন করে বছরের ৩৩০ দিনে মোট পাঁচ লাখ ২৮ হাজার টন ইউরিয়া সার উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে কারখানাটির।

কারখানা চালুর কয়েক বছর এই পরিমাণ সার উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও ধীরে ধীরে কমতে থাকে উৎপাদনের পরিমাণ। এর প্রধান কারণ হলো আয়ুষ্কাল পেরোনো যন্ত্রপাতিতে বারবার ত্রুটি ও গ্যাস সংকট।

কারখানা-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাধারণত একটি কারখানার যন্ত্রপাতি ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে সক্ষম। এই আয়ুষ্কাল পার হওয়ার পর যন্ত্রপাতিগুলোতে নানা ধারনের ত্রুটি দেখা দেয়।

তবে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় একটি মহল কারখানায় নতুন যন্ত্রাংশ সংযোজন না করে পুরোনো যন্ত্রপাতি মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে।

কারখানাটিতে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং সংস্কার ও মেরামতের নামে লুটপাটের অভিযোগে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম আনেয়ারুল হকসহ ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শিল্প মন্ত্রণালয় বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

অভিযোগ তদন্তে ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর একটি কমিটিও গঠন করে শিল্প মন্ত্রণালয়। কমিটি অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতাও পায়। পাশাপাশি ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তারা ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে।

অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল কারখানা ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ রাখা, অবৈধভাবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার, বেআইনিভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে ব্যক্তিগত ভ্রমণ, কারখানার প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ৭০-৭৫টি ক্রয়কার্যে নিম্নমানের দ্রব্য ক্রয় করা।
প্রতি ক্রয়ে ডিপিএম পদ্ধতি ব্যবহার না করে কারখানার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, কারখানা ওভারহলিংয়ের কাজে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, বিনা কারণে মেয়াদপূর্তি ও আগে এফডিআর ভাঙানো, দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে ২০-২৫ জন লেবার দিয়ে অর্থ আত্মসাৎÑ এ ধরনের বহু অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। তবে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের চাপে তদন্ত প্রতিবেদনটি আলোর মুখ দেখেনি।

এদিকে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। এই সিন্ডিকেটে রয়েছে সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার নাথ, বিভাগীয় প্রধান (কারিগরি) অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস, সিবিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন, ইউরিয়া প্লান্ট প্রধান একেএম জহিরুল ইসলাম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারি একেএম নূর আহমেদ পারভেজ।

কৃত্রিম সার সংকটসহ ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনার এজেন্ট হিসেবে তাদের দায়ী করে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের পক্ষে শফিউল আলম ২৬ জানুয়ারি শিল্প উপদেষ্টা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।

এসব বিষয়ে জানতে আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার নাথকে তার মুঠোফোনে (০১৮১৪-৮৩৫৩৫৮) বারবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

https://dailyamardesh.com/bangladesh/chattogram/amd8kakvhkklr