কয়েক দফা মেয়াদ বৃদ্ধির পর ৮ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্প। এ প্রকল্পের এক হাজার ৯২০ কোটি টাকার মধ্যে ৫৪১ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে সাবেক উপাচার্য মীজানুর রহমানের বিরুদ্ধে আন্দোলনও হয়েছিল।
এরপর সাবেক দুই উপাচার্য এমদাদুল হক ও সাদেকা হালিমের বিরুদ্ধেও দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসন বলছে, বিগত ১৫ বছরে নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্প ছাড়াও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগসহ বিভিন্ন সেক্টরের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে একটি শ্বেতপত্র অচিরেই প্রকাশ করা হবে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, সব মিলিয়ে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হলেও অজ্ঞাত কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন জড়িতরা।
আমার দেশ-এর মাসব্যাপী অনুসন্ধানেও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক শিক্ষা সচিব মাহবুব হোসেন, সাবেক ঢাকা জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মুহাম্মদ ফেরদৌস খান ও যুবলীগ নেতা ওমর ফারুকসহ বেশ কজনের বিরুদ্ধে অনিয়মে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
মীজানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
‘দায়িত্ব পেলে উপাচার্যের পদ ছেড়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান হতে রাজি আছি’ বলে বক্তব্য দেওয়া বহুল সমালোচিত সেই মীজানুরের বিরুদ্ধে নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম, একাডেমিক ভবন নির্মাণে দুর্নীতি, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম ও বাণিজ্য, পরিবহন ক্রয় ও ড্রাইভার নিয়োগে অনিয়ম, ভিন্নমতের শিক্ষকদের হয়রানিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তার টানা দুই মেয়াদে (২০১৩ সালের ২০ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৯ মার্চ) বেশিরভাগ অনিয়মের ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, সাবেক এ উপাচার্যের আমলে একাডেমিক ভবন ছয়তলা থেকে ১৫ তলা করতে ২০১৫ সালে দ্য বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে পরস্পর যোগসাজশে ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে অভিযোগ করেছিলেন শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন।
ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই ১১টি বাস ও দুটি মাইক্রোবাস কেনা এবং প্রশিক্ষণকালে দৈনিক মজুরি বিল দেওয়া হয়।
ইউজিসি বলছে, প্রশিক্ষণকালে ৬০০ টাকা হারে দৈনিক মজুরি বিল দিয়ে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। আবার একই প্রশিক্ষণে একই ব্যক্তিকে অতিথি এবং অংশগ্রহণকারী দেখিয়ে উভয় ক্ষেত্রে সম্মানি দেওয়া হয়।
উপাচার্য দপ্তর, রেজিস্ট্রার দপ্তরের একাডেমিক কাউন্সিল ও ব্যক্তিগত শাখায় কর্মকর্তাদের নিয়মবহির্ভূতভাবে সম্মানি এবং বই-ভাতা বাবদ শিক্ষকদের প্রতিবছর ৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্যও দেওয়া হয় টাকা।
চালক, বাসের সহকারী (হেলপার) পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ না থাকলেও তা করা হয় সাবেক এ উপাচার্যের আমলে। আবার চালক ও হেলপারদের তদারকির জন্য ভাতাও দেওয়া হয়।
এছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে সহস্রাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দেন সাবেক ওই উপাচার্য। এ নিয়ে শতকোটি টাকার বাণিজ্য সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করে নেন মীজান ও তার লোকজন। নিয়োগবাণিজ্য ও অনিয়মে নাম এসেছে সাবেক ভিসি মীজানের পিএস সৈয়দ ফারুক হোসেনের বিরুদ্ধেও। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
ইউজিসির বাজেট দল এসব অভিযোগসহ বিভিন্ন সময়ে ২৫টি বিষয়ে আর্থিক অনিয়ম ও আপত্তি জানায়। পাশাপাশি ক্ষতির টাকা আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে দেওয়ার জন্যও বলে।
এদিকে সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে গত ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল ইফতেখার আলম প্রকল্প পরিদর্শন করেন।
কেরানীগঞ্জের প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, প্রকল্পের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ আংশিক হয়েছে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সীমানা প্রাচীরের কাজ এখনো বাকি। ২০০ একরের মধ্যে ১১.৬০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণও বাকি। পুকুর ও লেক খননের কাজ চলছে।
লেকের পাড়ে মাটি আটকে রাখার জন্য পাথর ব্যবহার করলেও বর্ষা এবং পাড়ে গবাদিপশু বিচরণের কারণে মাটি ধসে লেকের কিছু কিছু অংশ ফের ভরাট হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলেও দরপত্র প্রক্রিয়ায় আটকে আছে মাটি ভরাটের কাজ।
প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে তা সর্বশেষ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে এ সময়ের মধ্যেও প্রকল্প শেষ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ভূমি উন্নয়নের কাজ করেছেন সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর আস্থাভাজন আরএন এন্টারপ্রাইজের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুক রুমি। আর লেক ও দেয়ালের কাজ করছে ইউআই-এডিএল যৌথভাবে। জুলাই বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুক রুমিসহ এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক পালিয়ে যান।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জমির দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। বিল এলাকায় জমির দাম শতকপ্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার স্থলে অধিগ্রহণ হয় গড়ে ৫ লাখ ৬ হাজার টাকায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর প্রভাবে সাবেক উপাচার্য মীজান ও ঢাকা জেলার সাবেক প্রশাসক আবু সালেহ মুহাম্মদ ফেরদৌস খানের সহায়তায় এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। এছাড়াও বিলের পতিত জমিতে রাতারাতি বিল্ডিং ও মুরগির খামার তৈরি করেও জমির দাম বাড়ানো হয়। এভাবে নয়ছয় করে প্রকল্পের অর্ধেক টাকাই লুটপাট করা হয়েছে। এ ছাড়াও হিন্দুদের অনেক বেওয়ারিশ জমিও প্রকল্পের ভেতরে রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা স্বপন মাহমুদ মোল্লা বলেন, যে দামে জমি অধিগ্রহণ দেখানো হয়েছে, ওই সময় এমন দাম ছিল না।
সুকুমার বর্মণ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, আমাদের অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন এখনো জমির টাকা বুঝে পাননি।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী জানান, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিপু তার পিএসের মাধ্যমে আমাকে ডেকে নিয়ে বিনা টেন্ডারে তার পছন্দের প্রতিষ্ঠান আরবারাকে কাজ দেওয়ার কথা বলেন। আমরা তা করতে কোনোমতে রাজি হইনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মাহবুব হোসেনও আরবারাকে কাজ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু সরকারি বিধি দেখিয়ে তখনকার মতো রক্ষা পেয়েছিলাম।
এই প্রকৌশলীর মতে, এ প্রকল্পের অনিয়মের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জড়িত ছিলেন বলে মনে হয়েছে। কেননা, টেন্ডার আহ্বানের আগেই সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক উপাচার্য মীজানুর আরবারার ড্রয়িং হাসিনাকে দেখিয়েছিলেন। সাবেক উপাচার্য মীজান থেকে শুরু করে সাদেকা হালিম পর্যন্ত কম-বেশি সবাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
এ বিষয়ে জবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করার মতো আমাদের সক্ষমতা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ত্রিপক্ষীয় মিটিংয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে ইউজিসি কমিটি গঠন করবে। বিগত দিনে শুধু ক্যাম্পাস প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি নয়, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। অচিরেই এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ কো হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিনা শারমিন বলেন, এ প্রকল্পসহ বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। তদন্ত করতে আমরা ইউজিসিকে চিঠি দিয়েছি।
এছাড়া চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে প্রকল্পটি দুর্নীতিতে জর্জরিত বলে উল্লেখ করে বর্তমান প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন বলেন, সাবেক উপাচার্য মীজানের আমলেই বেশি দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মসহ বিরোধী মতের শিক্ষকদের অযথা হয়রানি করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ শাখার পরিচালক মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, মন্ত্রণালয়ে ত্রিপক্ষীয় সমন্বিত মিটিং এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠির আলোকে একটি কমিটি হয়েছে; কিন্তু কমিটি কাজ শুরু করতে পারছে না।
অভিযোগ প্রসঙ্গে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছেÑ এটা আমি একাধিকবার বলেছি। তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগেই আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানকার কোনো বিষয় এবং রাজনীতি নিয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি নই।’
দুর্নীতির বিষয়ে প্রকল্পের সাবেক পরিচালক সৈয়দ আলী আহমেদ বলেন, প্রকল্পে আমার বিরুদ্ধে আনীত অনিয়মের অভিযোগ একেবারেই অসত্য।
প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক উপপ্রকৌশলী আমিরুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক নয়। এছাড়া প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থই জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে। ডিসি অফিসের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তা জেলা প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের হর্তাকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন।
ঢাকা জেলার সাবেক প্রশাসক ও বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু সালেহ মুহাম্মদ ফেরদৌস খান অনিয়মের কথা অস্বীকার করে বলেন, রেকর্ড জেলা প্রশাসনের অফিসে রয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাকমতোই করা হয়েছিল।