৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার

রমজানে অর্থনীতির চাকা ও ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজার

-মো: মাঈন উদ্দীন

মুসলমানদের বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ঘিরে মাহে রমজানের পুরো মাস অর্থনীতি সতেজ করে তোলে। পণ্যের হাতবদল, অর্থের স্থানান্তর অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার তৈরি হয়। রমজান ও ঈদ ঘিরে উৎপাদনকারীদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ক্ষুদ্র ও পাইকারি বিক্রেতারা এ মাসে তুলনামূলকভাবে অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ করে বাহারি রকমের পোশাক, পাদুকা, প্রসাধন সামগ্রী, ভালো নানা ধরনের খাবার, অলঙ্কারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে গ্রাহকদের ভিড় পরিলক্ষিত হয়। ব্যবসায়ীরা সারা বছরের বেচাকেনার অর্ধেকের বেশি এ মাসে করে থাকেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রচুর লেনদেন হয়। উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য উৎপাদনে ব্যস্ত সময় কাটায়। তবে একটি বিষয় প্রতি বছর পরিলক্ষিত হয়, তা হলো রমজান এলে আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশির ভাগ পণ্যের দাম অত্যধিক হারে বাড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ বেশির ভাগ মুসলিম দেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে রমজান ঘিরে নানা রকম ছাড়/অফার দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে পণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। রমজান আসা মানে জিনিসের দাম বাড়ার, বাড়তি মুনাফার সুযোগ নিতে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। যা কখনো কারো কাম্য নয়। এবারো বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২০০-২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগের সপ্তাহে ১৮০-২০০ টাকা ছিল। একইভাবে সোনালি মুরগির দাম বেড়ে ২৮০-৩১০ টাকা হয়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, রোজার শুরুতে বেশি সংখ্যায় ক্রেতারা মুরগি কেনেন, এ কারণে দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে।

মুরগির পাশাপাশি বেড়েছে গরু ও খাসির গোশতের দাম। বাজারে প্রতি কেজি গরুর গোশত ৭৫০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ দাম সপ্তাহখানেক আগে কিছুটা কম ছিল। এ ছাড়া ছাগলের গোশত বিক্রি হচ্ছে ১০৫০-১১০০ টাকায়। অন্যদিকে চাষের চিংড়ি, কই, শিং, তেলাপিয়া, রুই ও পাঙ্গাশ মাছের দাম কেজিতে ২০-৫০ টাকা বেড়েছে। বাজারে আলু, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন সবজির দাম আগের মতো স্থিতিশীল রয়েছে।

সাধারণত রোজার সময় লেবু, বেগুন ও শসার চাহিদা বেশি থাকে। বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। এদিকে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ-সঙ্কটের তেমন উন্নতি হয়নি। পত্র-পত্রিকার খবরে দেখা যায়, ভোক্তারা ঢাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে মাত্র কয়েকটি দোকানে স্বল্প পরিমাণে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাচ্ছেন। ভোক্তারা অভিযোগ করে বলেন, রোজার আগে কমবেশি দামে অন্যান্য পণ্য কিনতে পারলেও সয়াবিন তেলের জন্য দোকানে দোকানে ঘুরতে হচ্ছে।

পণ্যের দামের অস্বস্তি নিয়ে শুরু রমজান
আগেই বলেছি, পবিত্র রমজান ঘিরে নিত্যপণ্যের দামে ছাড় দেয়া হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তবে বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। রাতারাতি বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের দাম। সাধারণ ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়ে বহুগুণে। তবে এ বছর রমজানে চাহিদা বিবেচনায় বাড়তি জোগানের হিসাব দিয়েছে সরকার। বলা হয়েছে, সাধ্যের মধ্যে থাকবে দাম। এদিকে টিসিবির হিসাব বলছে, গত রমজানের তুলনায় লিটারে ৩০ টাকা বেড়েছে খোলা সয়াবিনের দাম। লিটারে ১০ টাকা বাড়লেও পাওয়া যাচ্ছে না বোতলজাত সয়াবিন। অবশ্য, শুল্ক ছাড়ের ফলে কেজিতে ২০ টাকা কমেছে চিনির দর। প্রতি কেজি খেজুরে কমেছে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। আর অপরিবর্তিত রয়েছে ছোলার দাম, প্রতি কেজি যা ১১০ টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু বড় ব্যবসায়ীর কব্জায় আমাদের পুরো বাজার। এ বিষয়ে সরকার কার্যকর কোনে উদ্যোগ নিতে পারছে না।
আলু আর পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বেশ খানিকটা কমেছে দাম। মসলাপণ্যে দ্বিগুণ বেড়েছে এলাচের দাম, প্রতি কেজি সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতি কেজি রসুনে গুনতে হচ্ছে বাড়তি অন্তত ২০ টাকা। দামের সূচকে আগের জায়গায় রয়েছে গরুর গোশতের দাম, কেজিতে সর্বোচ্চ ৭৮০ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লারে কমেছে অন্তত ২০ টাকা, যা এখন দুই শ’র ঘরে। কেজিতে ৩০ টাকা কমেছে সোনালি মুরগি। ডজনে ১০ টাকা কমে ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা পর্যন্ত।

র‌্যাপিডের গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ দিন ইসলাম বলছেন, লাগাম টানতে হবে আমদানি সিন্ডিকেটের। তিনি আরো বলেন, ডেডিকেটেড গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োগ দেয়া উচিত, যারা এদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনবে।
সিপিডির মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সঠিক নীতি গ্রহণের পাশাপাশি নির্ভরতা কমাতে হবে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের ওপর। প্রয়োজন নজরদারি আর আইনের কঠোর প্রয়োগ।

তবে এবার রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ভেজাল প্রতিরোধে মাঠে ভোক্তা অধিদফতর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ টিম, বিএসটিআইসহ সরকারের নানা দফতর থাকার কথা বলা হলেও এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না। প্রতি বছর রমজানে সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এবার ডালের বাজার স্থিতিশীল। গত তিন মাসের মধ্যে বাজারে ডালের দামের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য বলছে, বাজারে প্রতি কেজি মসুর ডাল (বড় দানা) ১০৫-১১০ টাকা, মসুর ডাল (মাঝারি দানা) ১১০-১২০ টাকা, মসুর ডাল (ছোট দানা) ১৩০-১৪০ টাকা, মুগ ডাল ১৩০-১৮০ টাকা, অ্যাংকর ডাল ৬০-৮০ টাকা এবং ছোলা মানভেদে ১০৫-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে দেশে গ্যাসসঙ্কট তীব্র। রমজান চলাকালীন সময়ে গরম বেড়ে যাবে। শিল্প আর বিদ্যুৎ খাত শুধু নয়- রান্নাঘরেও গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার দাবি তখন হয়ে উঠবে আরো জোরালো। বিশেষত ইফতার ও সাহরির সময় গ্যাস না থাকলে বিপদ। রান্নাঘরেও এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেড়ে উঠেছে। নতুন রেস্তোরাঁয়ও এর সরবরাহ আর দাম স্বাভাবিক রাখাটাও চ্যালেঞ্জের। আমাদের দেশের মানুষের সংস্কৃতির যেমন বড় একটি জায়গা দখল করে আছে রমজান, তেমনি অর্থনীতির জন্যও বিরাট এক আশীর্বাদ এ রমজান।

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রমজান যেভাবে প্রভাবিত করে। যেমন- টুপি ও আতরের বাজার। রমজান এলে বেড়ে যায় টুপি, মিসওয়াক ও আতরের চাহিদা। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন রকমের টুপির দোকানে এ মাসে দিনে লাখ টাকাও বেচাকেনা হয়। ১০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয় টুপি। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে তৈরি টুপি যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আসছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।

রমজানে ইফতারসামগ্রী নিয়ে বাজারে এক মহোৎসব দেখা দেয়। চিরায়ত বাংলার এক অনন্য সংস্কৃতি ইফতার। ইফতার আদান-প্রদানের সংস্কৃতিও বাড়ছে ক্রমে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও সংস্থার ইফতারের আনুষ্ঠানিক আয়োজন থাকে রমজানজুড়ে। বিভিন্ন শিল্প-কারখানাও শ্রমিকদের ইফতারি দিয়ে থাকে। দেশের বেশির ভাগ মসজিদে রমজানজুড়ে ইফতারের আয়োজন থাকে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে রমজানে প্রতিদিন কয়েক হাজার লোকের ইফতারের ব্যবস্থা থাকে। শরবতসহ বিভিন্ন হালাল পানীয়, চিরাচরিত মুড়ি, পেঁয়াজু, জিলাপি, বেগুনি, ছোলাসহ বিভিন্ন ধরনের নতুন খাদ্য প্রস্তুত করা হয় ইফতারের জন্য। এসব ঘিরে অর্থনীতির অনেক সেক্টর বেশ সরগরম থাকে।

আবার রমজান উপলক্ষে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ে। কারণ রমজানের পর ঈদুল ফিতর। আর ঈদের কেনাকাটা করার জন্য প্রবাসীরা একটু বেশি টাকা পাঠান দেশে। জাতীয় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে রমজানে। রহমত বরকতের এ পবিত্র রমজান মাসে একদিন যেমন আমাদের অর্থনীতিতে প্রচুর পণ্যের হাতবদল হয়, ব্যাংকের লেনদেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। ভোক্তারা চায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম তাদের আয়ত্তের মধ্যে থাকা। সরকারের উচিত টিসিবির কার্যক্রম আরো বাড়ানো। বাজারে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম রোধ করা যেতে পারে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
ইমেইল : main706@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/printed-edition/o7FzklAjFmHK/