কয়েকদিন আগে কুমিল্লা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ এর গুলীতে কামাল হোসেন (৩২) নামের এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হন। এরআগে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে স্বর্ণা দাস (১৪) নামে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে বিএসএফ গুলী করে হত্যা করে। এছাড়া আদিতমারী উপজেলার কুটিপাড় সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলীতে হেলালুজ্জামান ওরফে হেলাল উদ্দিন (৩৬) নামে এক বাংলাদেশীকে গুলী করে নিয়ে যায় বিএসএফ। এভাবে কিছুদিন পর পরই সীমান্তে বাংলাদেশিদেরকে গুলী করে হত্যা করছে বিএসএফ। এছাড়াও খাসিয়া সম্প্রদায়ের হাতেও খুন হচ্ছেন বাংলাদেশীরা। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার ভারত লাগোয়া সীমান্তে ভারতের খাসিয়া জনগোষ্ঠীর ছোড়া গুলীতে জমির আহমদ (২৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়।
কোনো অবস্থাতেই বিএসএফ এর হাতে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। সীমান্তে বাংলাদেশীদের ওপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যদের গুলীতে হত্যার ঘটনা দিন দিন আরো উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। চলতি মাসে আট দিনের ব্যবধানে দুজনকে গুলী করে হত্যা করা হয়। গত মাসে তিনজন নিহত ও তিনজন আহত হয়। সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও থামছে না ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলীতে প্রাণহানির ঘটনা। পতাকা বৈঠকেই সীমাবদ্ধ সমাধানের পথ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধের উদ্যোগ নেয়। বিএসএফ এর গুলীতে বাংলাদেশীদের হত্যার নিন্দা জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সীমান্তে হত্যাকা-কে ‘নিষ্ঠুরতা’ আখ্যায়িত করে তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে সীমান্তে বড় কোনো উত্তেজনা তৈরি হয়নি বলে জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেনেন্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, বিজিবি কখনো সীমান্তে পিঠ দেখাবে না, বুক দেখাবে। বিজিবিকে বলা হয়েছে, সীমান্তের যেকোনো ধরনের উত্তেজনায় কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। এছাড়া ভবিষ্যতে যাতে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনা আর না ঘটে সে বিষয়ে বাংলাদেশের দিক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার পিলখানায় ‘বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আর ৯ মার্চ সকালে যৌথ আলোচনার পর দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সীমান্ত সম্মেলন শেষ হয়। মূলত ঢাকায় সীমান্ত সম্মেলনে অংশ নেয়া শেষে বিএসএফ প্রধানের ফিরে যাওয়ার পর তাদের মারমুখী অবস্থান বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। এরপর অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে গত ৬ ডিসেম্বর পঞ্চগড় সীমান্তে আনোয়ার হোসেন (৩৬) নামে এক বাংলাদেশী নাগরিককে বিএসএফ কর্তৃক নির্মম হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিবৃতিতে সরকারের প্রতি অবিলম্বে সীমান্তে হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবির। ঢাবি শিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম ও সেক্রেটারি এস এম ফরহাদ এ দাবি জানান।
সীমান্তে ১৫ বছরে ছয় শতাধিক হত্যা : বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও গণমাধ্যমের খবরে এসেছে, সীমান্তে গত ১৫ বছরে ছয় শতাধিক বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। অথচ সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে ভারতকে। বিএসএফ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মধ্যে সীমান্ত সম্মেলন বা পতাকা বৈঠক হয়। সেখানে প্রতিবারই সীমান্তে আর গুলী চালাবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফ। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা হয় না।
এসব হত্যাকা-ের একটিরও বিচার হয়নি। এমনকি বিএসএফ বা ভারত সরকার হত্যাকা-ের কোনো ঘটনায় কখনো উদ্বেগও প্রকাশ করেনি। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জবাবদিহির বাইরে থাকার কারণেই মূলত সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক আইন কোনো বাহিনীকে বিশ্বের কোথাও নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের গুলী বা নির্যাতন করার অনুমতি দেয় না। তাই এই মুহূর্তে সুষ্ঠু সমাধান জরুরি। কারণ বিজিবির গুলীতে তো কেউ মারা যাচ্ছে না। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফের গুলীতে ও নির্যাতনে অন্তত ৬০৭ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের জানিয়েছে, ২০০৯ থেকে চলতি বছরের (২০২৪) জুন পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যদের হাতে অন্তত ৫৮২ বাংলাদেশী নিহত এবং ৭৬১ জন আহত হয়েছে।
একটি প্রাণও না ঝরে : ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে যাতে আর কোনো বাংলাদেশী নাগরিক হত্যাকা-ের শিকার না হয়, সে বিষেয় সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গত ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে আয়োজিত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এ কথা বলেন। সীমান্তে বিএসএফের বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘বর্ডার কিলিং নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ করেছি। আমি আশা করবো ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না।’
তৎপর ভারতীয় কোস্টগার্ড: গত সোমবার দুপুরে বাংলাদেশের খুলনা জেলার হিরণ পয়েন্টের অদূরে মাছ ধরার সময় ভারতের কোস্টগার্ড ৭৯ নাবিকসহ দুটি নৌযান আটক করে নিয়ে যায় ভারতীয় কোস্টগার্ড। এখন পর্যন্ত ৭৮ বাংলাদেশী নাবিকের ছবি প্রকাশ করা হলেও, বাকি একজনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। ভারতীয় কোস্টগার্ড ৭৮ বাংলাদেশী নাবিকসহ দুটি ট্রলারের ছবি প্রকাশ করে পরদিন মঙ্গলবার রাতে। কোস্টগার্ড তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ও এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) এ সংক্রান্ত তিনটি ছবি প্রকাশ করে। ফেসবুকে পোস্ট করা তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় সমুদ্রসীমায় মৎস্য আহরণের অভিযোগে ৭৮ বাংলাদেশী নাবিকসহ দুটি ট্রলার আটক করা হয়েছে। এসব নাবিক ও ট্রলার প্যারা দ্বীপের কাছে আটক করা হয়েছে। ভারতীয় কোস্টগার্ডের প্রকাশ করা ছবিতে দেখা যায়, আটক নাবিকরা ট্রলারের ডেকের ওপর হাত মাথার পেছনে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন, আর তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন ভারতীয় কোস্টগার্ড সদস্যরা। অন্য একটি ছবিতে সাগরে অবস্থানরত দুটি ট্রলার দেখা যায় এবং তৃতীয় ছবিতে, ট্রলার দুটি জেটিতে নিয়ে আসার দৃশ্য ফুটে ওঠে। আটক ট্রলার দুটি হলো, এফভি লায়লা-২ ও এফবি মেঘনা-৫। এফভি লায়লা-২ ট্রলারটি এস আর ফিশিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের এবং এফভি মেঘনা-৫ ট্রলারটি সিঅ্যান্ডএফ অ্যাগ্রো লিমিটেডের মালিকানাধীন। সিঅ্যান্ডএফ অ্যাগ্রো লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সুমন সেন জানান, সোমবার সকালে ট্রলার দুটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার এক নটিক্যাল মাইলের মধ্যে মাছ ধরছিল, তখন ভারতীয় কোস্টগার্ড তাদের আটক করে নিয়ে যায়।