বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সরবরাহ করা ৩৪ টন পেঁয়াজের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ৫৯ জেলায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে এক কেজি করে মাগনা পেঁয়াজের বীজ পেয়ে ৩৪ হাজার কৃষকের মলিন মুখে ফুটেছিল চওড়া হাসি। প্রণোদনার এই বীজ যে এতটা যন্ত্রণার ঝাঁজ হয়ে ফিরবে, আন্দাজও করতে পারেননি চাষিরা। ঠিক সময়ে, সঠিক নিয়মে বীজ বপন করার পরও ৯৫ শতাংশ পেঁয়াজ চারা মাটি ফুঁড়ে বের হয়নি। বীজ থেকে পেঁয়াজ না আসায় এ বছর হাজার হাজার চাষির স্বপ্ন মাঠে মারা। এ পরিস্থিতির জন্য কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদেরই দুষছে কৃষককুল।
কৃষকের অভিযোগ, সরকার যে পেঁয়াজ বীজ দিয়েছে, তা ভেজাল। বিএডিসির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার কারসাজিতেই এমন সর্বনাশ হয়েছে। একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে এভাবে নিম্নমানের ভেজাল বীজ কৃষকের হাতে তুলে দিচ্ছে। বীজ আমদানির নামে কোটি কোটি টাকা লুটে নিলেও এখনও তারা অধরা। অবশ্য অভিযোগ আসার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিকে ফের বিনামূল্যে উন্নত মানের পেঁয়াজ বীজ সরবরাহও করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিএডিসি গঠন করেছে আলাদা তদন্ত কমিটি। প্রণোদনার পেঁয়াজের বীজে ভেজাল ছিল, এরই মধ্যে তদন্তে প্রমাণ পেয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তারা প্রণোদনার নামে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে কৃষক এভাবেই ঠকবেন। এতে নির্দিষ্ট সময়ে হালি পেঁয়াজ বাজারে আসবে না। কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
মাঠে মাঠে কৃষকের রোদন
রাজবাড়ীর কালুখালীর চরশ্রীপুর গ্রামের চাষি বাচ্চু খান। বলছিলেন, ‘কী দানা দিল কৃষি অফিসাররা? আমার তো বিশাল ক্ষতি হয়া গেল! সরকার কৃষকের দানা দেছে উন্নতির জন্নি, না ক্ষতি করার জন্নি? এ বছর চাষ মাইর গেল। এই জমিতি এহন কিছু করা যাবি নানে।’ একই জেলার বালিয়াকান্দির পূর্ব মৌকুড়ি গ্রামের কৃষক নূর হোসেন মিঞার চোখেও এখন রোদন। বারুদ-কণ্ঠে নূর হোসেন বলেন, ‘পাশের জমিতে চাষিরা বাজার থেকে বীজ লাগিয়েছে। সেই জমিতে তরতর করে পেঁয়াজের গাছ বেড়ে উঠছে। ভেবেছিলাম, সরকারি বীজে ভালো ফলন পাব। ফলন তো দূরে, বীজই গজায়নি। সরকার আমার যে ক্ষতি করেছে, বিচার কোথায় পাব?’
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর হোগলাকান্দি গ্রামের কৃষক তুহিন মোল্লা কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনার এক কেজি পেঁয়াজ বীজ দিয়ে বপন করেছেন। ১০ দিন পর মাত্র ৫ শতাংশ চারা গজিয়েছে। এ এলাকার আরও কয়েকজন প্রণোদনার বীজ বপন করেছিলেন। সবারই একই হাল।
দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের বড় একটি অংশ আসে রাজবাড়ী ও ফরিদপুর থেকে। রাজবাড়ীর চার হাজার কৃষককে দেওয়া হয়েছিল বীজ। সেই বীজ বপনের পর অঙ্কুরোদ্গম হয়নি। বিএডিসি থেকে সরবরাহ করা বীজ না গজানোয় কৃষিজমি পতিত পড়ে আছে।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, প্রাথমিকভাবে চার হাজার কৃষকের মধ্যে ৩ হাজার ৭২৫ জনের মতো ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দ্রুত নতুন করে বীজ দেওয়া হচ্ছে।
ফরিদপুরের সালথার মাঝারদিয়া ইউনিয়নের কাগদী গ্রামের চাষি আহসান মোল্যা বলেন, ‘আমারে এক কেজি পেঁয়াজের দানা (বীজ) দিছিল। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেই বীজ জমিতে বপন করেছি। কিন্তু একটা দানাও গজায়নি।’ প্রণোদনার বীজে আহসানের মতো ফরিদপুরের সালথা ও পাশের নগরকান্দা উপজেলার অন্তত ২৫০০ কৃষকের কপাল পুড়েছে।
নগরকান্দার কৃষি কর্মকর্তা তিলক কুমার ঘোষ বলেন, ‘আমাদের কাজ বীজ বিতরণ করা। বীজ পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব বিএডিসি কর্মকর্তাদের।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে নতুন করে বীজ দেওয়া হচ্ছে। বীজ না গজালেও উৎপাদনে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। এখনও বীজ বপনের সময় আছে। বিষয়টি মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। বীজে ভেজাল ছিল, তা তদন্তে পাওয়া গেছে।
কৃষি বিভাগের কারসাজি
পেঁয়াজ সংকট কমাতে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বীজ আমদানির মাধ্যমে কৃষককে প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। এই বীজ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমদানি না করে বিএডিসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সুযোগে বিএডিসির একটি চক্র নিম্নমানের বীজ আমদানি করে কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। এবারও এর ব্যত্যয় হয়নি। এ মৌসুমে পেঁয়াজ বীজে কেন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে– তা এখনও খোলাসা করেনি কৃষি বিভাগ। বিএডিসি বলছে, এবার তাদের নিজস্ব উৎপাদিত বীজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এটি বদলে নিম্নমানের বীজ কৃষককে সরবরাহ করা হতে পারে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বিএডিসি যে বীজ দিয়েছে তারা সেগুলোই কৃষকের হাতে দিয়েছে। এখানে অনিয়ম হয়নি।
এদিকে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গ্রীষ্মকালীন প্রণোদনার বীজ সরবরাহের জন্য বিভিন্ন কোম্পানির কাছে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে নামিদামি অনেক কোম্পানি অংশ নেয়। দরপত্রে লাল তীর প্রতি কেজি বীজের দাম দেয় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। অথচ ভালো কোম্পানির বীজ না নিয়ে গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি আনকোরা কোম্পানি থেকে ২ হাজার ৫০ টাকা দরে বীজ কেনা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ভালো বীজ কিনতে অন্তত সাড়ে ৪ হাজার টাকা লাগে। অথচ বাড়তি সুবিধা নিয়ে মাত্র দুই হাজার টাকায় বিএডিসি নিম্নমানের বীজ কিনেছে। এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ) মো. মোস্তাফিজুর রহমান। মোস্তাফিজুরের চাকরির মেয়াদ শেষ হলে গত ২ জানুয়ারি এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। ক্রয় আইন না মেনে কমিশনের মাধ্যমে তিনি পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে বীজ সরবরাহের কার্যাদেশ দেন। তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা বীজের গুণগত মান সঠিকভাবে পরীক্ষাও করা হয় না। বিএডিসির অধীন কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। গত অর্থবছরেও তাঁর পছন্দের প্রতিষ্ঠান ‘বঙ্গ অ্যাগ্রিকেট’ বীজ সরবরাহের কার্যাদেশ পায়।
এর আগে কালো তালিকাভুক্ত সততা বীজ ভান্ডারসহ নামসর্বস্ব অন্য কোম্পানির নামে কোটি কোটি টাকার বীজ কেনা হয়েছিল। গত অর্থবছরে সরকার বিনামূল্যে কৃষকের মধ্যে যে বীজ বিতরণ করেছিল, তা সততা বীজ ভান্ডার ভারত থেকে এনে সরকারকে সরবরাহ করে। তবে প্রতিষ্ঠানটির ৮০ শতাংশ বীজেরই চারা গজায়নি।
এ ব্যাপারে বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এবারের সরবরাহ করা বীজ বিএডিসির নিজস্ব উৎপাদিত, এটা আমদানির নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভালো বীজ দেওয়া হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে বিতরণে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা, তা তদন্ত কমিটি খুঁজে দেখবে।
লুটপাটের লম্বা হাত
বীজ আমদানির নামে লুটপাট নতুন ঘটনা নয়। অতীতেও লুটপাট হয়েছে, সবার চোখের সামনেই কৃষক কেঁদেছেন। থামেনি বীজ মাফিয়াদের অরাজকতা। পুরো বীজ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি কৃষিবিদ ড. আওলাদ হোসেন, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাকের বন্ধু ও কুয়েত আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফারুক হোসেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলু, বিএডিসির বীজ উইংয়ের সদস্য পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, সাবেক এমপি মাশরাফি বিন মুর্তজার চাচা পরিচয়দানকারী জিল্লুর রহমান, বীজ কোম্পানির মালিক পবিত্র ভান্ডারি, আলমাস উদ্দিন সুমনসহ আরও কয়েকজন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএডিসির একটি প্রকল্পের মাধ্যমে গত চার বছরে ১৫৬ টন গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ আমদানি করা হয়। এন-৫৩ নামে ভারতীয় এই জাতের পেঁয়াজের বীজ আমদানির পেছনে খরচ দেখানো হয় প্রায় ৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ টন পেঁয়াজের বীজ আমদানির একটি হিসাবের নথি সমকালের হাতে এসেছে। সিন্ডিকেটের করা ভাগবাটোয়ারার গোপন নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৮ টন পেঁয়াজের বীজ ভ্যাটসহ বাংলাদেশে নিয়ে আসা পর্যন্ত খরচ হয়েছে দুই কোটি ৪১ লাখ ১৫ হাজার ৮৫৭ টাকা। বাকি প্রায় এক কোটি ৬৪ লাখ টাকা বিভিন্ন জনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়েছে। বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ) মোস্তাফিজুরকে ২৫ লাখ টাকা, ড. রাজ্জাকের ছেলের বিয়েতে পাঁচ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের সাবেক ডিজি মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলু এক লাখ টাকা, তখনকার (২০২২-২৩ অর্থবছর) পিডি (ওনিয়ন) ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, টিভি প্রোগ্রাম বাবদ দেড় লাখ টাকা, ফিন্যান্সিয়াল খরচ বাবদ ১২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। অন্য দিকে ফারুক, জিল্লুর, রাসেল ও সুজাত নামের চারজনের একেকজনকে ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য খরচ এক লাখ ৯৫ হাজার এবং ট্যাক্স ৩ শতাংশ হারে ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪০ টাকা হিসাবের খাতায় রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই বীজ আমদানির টাকা ভাগবাটোয়ারার মূল হোতা ফারুক হোসেন। তিনি ড. আব্দুর রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠ। জিল্লুর রহমান কৃষি মন্ত্রণালয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজার চাচা হিসেবে পরিচিত। রাসেল ও সুজাত নামের দু’জন বীজ কোম্পানি ‘বঙ্গ অ্যাগ্রিটেকে’র মালিক।
২০১০ সালে সিনজেনটা কোম্পানির হাইব্রিড ‘সবল’ টমেটো বীজ চাষ করে প্রতারিত কৃষকের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ। তিনি বলেন, কোম্পানির বীজ ও উপকরণ ব্যবহার করে কৃষক প্রতারিত হচ্ছেন। তবে দোষী কোম্পানির কোনো বিচার হয়নি। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বীজ কিনে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বীজ কোম্পানির প্রতারণা এবং বিএডিসিসহ বীজ খাতে দুর্নীতি এবং অবহেলাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বীজ খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রসংস্কারে বিবেচনা করতে হবে। কারণ এর ওপর নির্ভর করছে আমাদের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন। গ্রামে গ্রামে নারী কৃষকের মাধ্যমে বীজব্যাংক এবং বীজ উৎপাদন ও বর্ধন কর্মসূচিকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা বাড়াতে হবে।
এ ব্যাপারে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, এবার ৯০০ কেজির মতো প্রণোদনার বীজে সমস্যা ছিল। আমরা দ্রুত বীজ কোম্পানি লাল তীরের সঙ্গে কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নত বীজ এনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের হাতে দিয়েছি। তিনি বলেন, পেঁয়াজের বীজ না গজানোর বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছি। তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এ ব্যাপারে কারও গাফিলতি থাকলে ছাড় দেওয়া হবে না। আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছি।