৯ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার

কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গেই ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্ক রাখতে পারছে না ভারত

ভারত তার কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গেই ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্ক রাখতে পারছে না। এসব দেশের সীমান্তে অথবা কূটনৈতিকভাবে কোনো না কোনাপ্রকারের ঝামেলা লেগেই থাকছে। সর্বশেষ অন্যতম প্রতিবেশী বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের জেরে ভারত অহেতুক তার সঙ্গে সম্পর্ককে ‘নেতিবাচক’ করে রেখেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

‘প্রতিবেশীরা সবার আগে’ এই নীতির ভিত্তিতে সাধারণত প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে থাকে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সারা পৃথিবীতেই এই নীতি মোটামুটি অনুসৃত হয়ে থাকে। কোনো দেশের একই সঙ্গে অনেকগুলো প্রতিবেশী থাকলে সবার সঙ্গেই বৈরী সম্পর্ক হতে দেখাটাও একটা বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের ক্ষেত্রে সেই পরিস্থিতি চলমান রয়েছে।
ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। এর পরেই রয়েছে চীন। অন্য সীমান্তবর্তী দেশগুলো হলো পাকিস্তান, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান। এছাড়া সমুদ্রসংলগ্ন নিকটবর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা এবং এর পরেই রয়েছে মালদ্বীপ। সীমান্তবর্তী না হলেও কাছাকাছি রয়েছে আফগানিস্তান।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ‘মধুরতম’ সম্পর্কের কথা গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করা হতো যে দেশটি নিয়ে সেটি যে ‘বাংলাদেশ’ তা কারো কাছেই অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু সর্বশেষ মধুরতম দেশটিও ভারতের রাডারের বাইরে চলে গেছে বলে ভারতীয়রা মনে করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানাপ্রকার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হচ্ছে। গত ৫ আগস্ট তাদের পছন্দের দল আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারত যেনো একেবারে ভেঙে পড়েছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় মিডিয়ার একটি অংশ, সরকারি দল বিজেপি’র বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে অপতথ্য প্রচার করেন। এরই জেরে আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলার ঘটনাও ঘটে। ভাষ্যকারদের বক্তব্য হলো, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া এভাবে প্রকাশ করায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার নগ্ন চিত্র প্রকাশ্যে এসেছে। এই পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে ভারতের সাবেক কূটনীতিক টি এস তিরুমূর্তি তাঁর কূটনৈতিক পর্যালোচনা করেছেন এভাবে: “পরপর অনুষ্ঠিত হওয়া চারটি নির্বাচন বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে অপ্রতিরোধ্য করবে বলে যখন মনে হচ্ছিল, তখনই ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটলো। সেই পতন ঘটলো গণতন্ত্রের ঘাটতি, অর্থনৈতিক মন্দা আর ছাত্রবিক্ষোভের বিরুদ্ধে সহিংসতার ভারে। এর জন্য ভারত মোটেও প্রস্তুত ছিল না।” তিরুমূর্তি প্রশ্ন তোলেন, “ভারত কি এসব ঠেকাতে পারতো? এর উত্তর হয়তো ‘হ্যাঁ’ হতে পারতা, যদি তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘটতো। কিন্তু কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে, বিশেষ করে যেখানে দুই পক্ষের জাতীয় স্বার্থের প্রতি বোঝাপড়া থাকে, তখন একজন নেতাকে পথ পরিবর্তনের জন্য কতোটা চাপ দেয়া উচিত, তা নির্ধারণ করা কঠিন। শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে আলোচনা আছে। আসুন, আমরা বাস্তববাদী হই। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংযোগের মতোই ব্যক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তার দলের পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যান্য দলের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক বজায় রাখতে ভারতকে কেউ বাধা দেয়নি। ভারত কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।”

পাকিস্তানের সঙ্গে চিরবৈরিতা : পাকিস্তানের সঙ্গে চিরবৈরিতার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পর থেকে দুই দেশ অন্তত তিনটি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং বহুসংখ্যক প্রক্সি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গেছে। দুদেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য দুই পক্ষই পরস্পরের প্রতি অভিযোগের তীর ছুড়ে চলেছে গত পৌনে এক শতাব্দি জুড়ে। কাশ্মীর সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখা (যুদ্ধবিরতি রেখা) বরাবর দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে দফায় দফায় গুলী বিনিময় স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের পর মাঝেমাঝে সম্পর্কের কিছু উন্নতি হয় বটে তবে তা যেন তাসের ঘরের মতো। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর দুই দেশের সম্পর্কের আবারো চরম অবনতি হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে, ভারত ও পাকিস্তান তিনটি বড় যুদ্ধ এবং একটি অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং বহু সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং সামরিক তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে; ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাদ দিলেও কাশ্মীর সংঘাত দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিটি যুদ্ধের জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক : নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে নেতিবাচক খবরাদির বয়স খুব বেশি নয়। তবে নেপালে রাজতন্ত্রের স্থান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বদলে যাওয়ার পর থেকে এই সম্পর্কের পারদ ব্যাপক উঠানামা করতে থাকে। চীনাঘেঁষা বামপন্থী সরকার বনাম ভারতঘেঁষা নেপালি কংগ্রেসকে ঘিরেই প্রধানত এই উঠানামার খেলা চলতে থাকে। ২০১৫ সালের নবেম্বরে একটি ঘটনা ভারত ও নেপালের মধ্যে শীতল উত্তেজনার ¯্রােত প্রবাহিত হতে থাকে। ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ‘অবজ্ঞা’ করার নীতি নিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে নেপালকেও আলাদাভাবে বিচার করতে ব্যর্থ হয়। একজন বিশ্লেষক বলেন, নেপালে নতুন সংবিধান রচনার কালে ভারত ভেবেছিল, তাতে নতুন নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্ক হবে আগের নেপাল-ভারত কলোনিয়াল দাসত্ব চুক্তির মতোই। স্বভাবতই দিন বদলেছেÑ সেটা বুঝতে ভুল এখানেই। অথচ ভারত বাস্তববাদী হতে পারলে অন্য কিছু হতে পারত হয়তো। বলাবাহুল্য, সেটা কখনোই হয়নি। উল্টো নেপালের মূল তিনটি রাজনৈতিক দল (নেপালি কংগ্রেস, লিবারেল বা ট্র্যাডিশনাল কমিউনিস্ট আর সশস্ত্র ধারার নতুন মাওবাদী কমিউনিস্ট) যারা একসাথে সংসদের মোট ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আসনে প্রতিনিধিত্ব করেÑ এদের সবার সাথে ভারতের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে যায়।

ভুটান-ভারত টানাপোড়েন : একদা যে ভুটান ভারতের আস্থাভাজন ও প্রায় অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল সেই ভুটানও ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েনের সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। হিমালয় রাজ্য ভুটান এবং ভারতের প্রজাতন্ত্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঐতিহ্যগতভাবে ঘনিষ্ঠ এবং উভয় দেশই একটি ‘বিশেষ সম্পর্ক’ নিয়ে নিশ্চিত ছিল। ভুটানের পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যে ভারত প্রভাবশালী। ভুটান ভারতের বৈদেশিক সাহায্যের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী। কিন্তু ১৯১৭ সালে এই সম্পর্কে চিড় ধরে। বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারত, ভুটান ও চীনের সীমানা যেখানে মিশেছে, সেই ‘ডোকলাম’ উপত্যকায় অব্যাহত সামরিক উত্তেজনার মধ্যেই দিল্লি ও থিম্পুর কর্তৃপক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক কোনদিকে গড়াচ্ছে- তা নিয়ে ভারতের মধ্যেই নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ভারত ও ভুটানের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ প্রায় ৭০ বছরের পুরনো, কিন্তু সেই সম্পর্কে চীনের ছায়া পড়ছে বলে সম্প্রতি ভারতেই অনেক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক মনে করছেন। এই পটভূমিতে হিমালয়ের পার্বত্য দেশ ভুটানকে ঘিরে দুশ্চিন্তা বাড়ছে ভারতেও। চীন-ভারত সামরিক সংঘাতকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যখন পার্লামেন্টে বিবৃতি দেন, তখন বিরোধীদের সমালোচনা ছিল: বর্তমান সরকারের আমলে সব প্রতিবেশীর সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে।

চীন-ভারতের ‘ঠেলাঠেলি’ : চীনের সমকক্ষ না হলেও পৃথিবীর দুই বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে চীনের অবস্থান ভারতের জন্য বরাবরই অস্বস্তিকর হয়ে রয়েছে। একে ‘ঠেলাঠেলি’র সম্পর্ক বলা চলে। ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের বড়রকম ‘মার খাওয়া’ থেকে আজ অবধি অরুণাচল ও লাদাখে অবিরাম পাল্টাপাল্টি দুনিয়াবাসী প্রত্যক্ষ করে আসছে। এর আগে তিব্বত নিয়ে বিরোধ ভারত আর এগোতে দেয়নি। এই সুবৃহৎ ভূখ-ের উপর চীনের দাবি ভারত হজম করতে বাধ্য হয়েছে। যদিও তিব্বতের নেতা দালাই লামাকে দিল্লি আশ্রয় দিয়ে রেখে চীনের জন্য অস্বস্তি স্থায়ী করে রেখেছে। অন্যদিকে অরুণাচল রাজ্যের একটা বড় অংশকে তিব্বতের অংশ বলে চিহ্নিত করে চীন এর উপর তাদের দাবি অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রটনা রটে যায় যে, চীনের সামরিক বাহিনী ভারতের অরুণাচল প্রদেশের প্রায় ৬০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়েছে বলে স্থানীয় গুঞ্জনের পর এবার আরেক খবরে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে ভারতে। এই অরুণাচল প্রদেশেরই স্পর্শকাতর অঞ্চলের কাছে অত্যাধুনিক সুবিধা-সম্পন্ন হেলিপোর্ট বানাচ্ছে চীন। যদিও দুপক্ষেই এর সুস্পষ্ট কোনো স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির ঘোষণা পাওয়া যায়নি। অপরদিকে ভারতের কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল লাদাখে কিছুদিন আগে দুই পক্ষের সেনাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা বিশ^সংবাদ হয়েছিল। নতুন করে দিল্লির সমপরিমাণ এলাকা দখল করেছে চীনÑ এমনটাই দাবি করেছেন দেশটির জাতীয় কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী। খুব সম্প্রতি তিনি বলেছেন, লাদাখে নয়াদিল্লির আয়তনের সমান ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ভূমি দখল করেছে চীনা সেনারা। এটি একটি বিপর্যয় পরিস্থিতি বলেও জানিয়েছেন তিনি।

মিয়ানমার নিয়ে বেকায়দা : আরেক সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী মিয়ানমার তথা সাবেক বার্মা নিয়ে বেশ বেকায়দায় রয়েছে ভারত। ভারত একটি গণতন্ত্র-সমর্থক দেশ বলে দাবি করলেও মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রায় সবগুলো নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক কর্মকা-ের সহযোগী হিসেবে নিজেদের জাহির করে এসেছে। এর প্রধান কারণ একদিকে চীনের মোকাবেলায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা এবং দ্বিতীয় কারণ সেভেন সিস্টার্সকে মিয়ানমারের অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখা। কেননা ভারতের যেটুকু সীমান্ত মিয়ানমারের সঙ্গে রয়েছে তা সেভেন সিস্টার্সকেন্দ্রিক। তবে জান্তাবিরোধীরা যেভাবে শক্তি ও সাফল্য অর্জন করছে তাতে ভারত জান্তার উপর একতরফা ভরসা করে থাকতে পারছে না।

শ্রীলংকা থেকে আঘাত : ভারতের সমুদ্র সীমানার নিকটবর্তী দেশ শ্রীলংকা। এই দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অতীতে উজ্জ্বল থাকলেও বিভিন্ন সময়ে তাতে ঘাত-অভিঘাতের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। সম্প্রতি এই সম্পর্কেও বড়ো রকম ফাটলের সূচনা হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। দেশটির চীনের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতায় ভারত তা কীভাবে সামাল দেবে তা যেনো বুঝে উঠতে পারছে না। শ্রীলংকায় শুরু হয়েছে ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলন। সম্প্রতি দেশটির কর্তৃপক্ষ ভারতের সাথে সম্পৃক্ত একটি কোম্পানিকে বিমানবন্দরে ভিসা প্রসেসিংয়ের দায়িত্ব হস্তান্তর করলে এই আন্দোলন গতি পায়। বলা হচ্ছে, শ্রীলংকায় ভারতীয় আধিপত্য রুখে দিতে শুরু হয়েছে এই আন্দোলন।

সেখানে দেশটিতে ভারতের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তারা দাবি করে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ও কৌশলগত খাতগুলো এখন ভারতীয় আধিপত্যবাদের দখলে। এর একটি নমুনা দৃষ্টিগোচর হয়েছে বিমানবন্দরের এই ঘটনার মধ্য দিয়ে। এক আন্দোলনকর্মী গণমাধ্যমকে জানান, “আমরা ভারতীয় আধিপত্যবাদের দাস নই। সে জন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে আমরা আরো কঠোরভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে যাবো।” প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের আমলে ভারতের সঙ্গে শ্রীলংকার সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। চীনপন্থী রাজাপক্ষে শ্রীলংকার দরজা চীনের জন্য হাট করে খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু, ২০১৫-র জানুয়ারিতে রাজাপক্ষেকে হারিয়ে বিপুল জয় পান ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত মৈত্রিপালা সিরিসেনা। প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা শ্রীলংকায় চীনা বিনিয়োগে নির্মীয়মান প্রকল্পগুলোর কাজ থামিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি আবার ঘুরে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মাথাতেই ফের শ্রীলংকায় বাড়তে শুরু করেছে চীনের প্রভাব।

মালদ্বীপের ধাক্কা : ভারত মহাসাগরের আরেক সমুদ্র-প্রতিবেশী মালদ্বীপ নিয়েও স্বস্তিতে নেই ভারত। প্রায় সম্পূর্ণ মুসলিম জন-অধ্যুষিত মালদ্বীপে নির্বাচন হলো মাত্র কিছুদিন আগেই। নির্বাচনের ফলাফলও ছিল ভারতের জন্য অপ্রত্যাশিত। সেখানেও ভারত প্রায় বাংলাদেশের মতো একই ভুল করেছিল। প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর বিশাল জয়ের জন্য নয়াদিল্লি প্রস্তুত ছিল না। তাই তার সঙ্গে আগে থেকে কোনো সংযোগও গড়ে তোলেনি। ভারত তখন প্রেসিডেন্ট নাশিদকে জোট গড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে পরামর্শ দিতে দ্বিধা করেনি। তবে নাশিদ সেই পরামর্শ শোনেননি। পরে তাঁকে প্রেসিডেন্টের পদ হারাতে হয়।

নভেম্বর ২০২৩-এ মালদ্বীপের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোহাম্মদ মুইজ্জু দায়িত্ব নেয়ার পর, মালদ্বীপ ভারত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, ভারত ও মালদ্বীপ সরকারের প্রধানরা পরস্পরের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী মন্তব্যের অভিযোগ তুলে ‘অবমাননাকর মন্তব্যে’ জড়িয়ে পড়েন। মালদ্বীপ এখন অনেকটাই চীনের প্রতি নির্ভরতা বাড়াতে শুরু করেছে দেখে ভারতও সম্পর্ক মেরামতের জন্য নানান উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ইতোমধ্যে ভারত যে ধাক্কা খেয়েছে তার কতটা হজম করতে পারবে আর কতটা বদহজমের শিকার হবে সেটি দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

আফগানিস্তান প্রসঙ্গ : ভারতের সরাসরি সীমান্তে অবস্থিত না হলেও আফগানিস্তানকে অনেকটাই ভারতের প্রতিবেশী তুল্য মনে করা হয়ে থাকে। অতীতের নানান উত্থান-পতনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে শরিক থেকেছে ভারত। বিশেষত তালেবানবিরোধী অভিযানগুলোতে ভারত সেখানে রাজনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যের অংশীদারে পরিণত হয়। তবে ২০২১ সালের আগস্টে, তালেবানরা আফগানিস্তানে ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দুই দশক পর জোর করে ক্ষমতা দখল করে। ভারত এর পূর্বাভাস পেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের আফগানিস্তানে অবস্থানের দিনগুলোতে ভারত একেবারে নির্বিঘেœ সেখানে মৌচাক নির্মাণ করে মধু আহরণ করে চলে। কিন্তু ন্যাটোর বিদায়ের পর তাকেও পাততাড়ি গোটাতে হয়। পিছনে ফেলে আসতে হয় মধুভরা মৌচাক। সেই যন্ত্রণাও সইতে হচ্ছে ভারতকে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, সাধারণভাবে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে আয়তন, জনসংখ্যা এবং আর্থ-সামরিক শক্তি দিয়ে বিচার করে একপ্রকার ‘অবজ্ঞা’ করার নীতি নিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই নীতিই তার জন্য বুমেরাং হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।

https://dailysangram.info/post/575447