৮ ডিসেম্বর ২০২৪, রবিবার

অনেক কোম্পানির ব্যালেন্স শিটে টাকা থাকলেও বাস্তবে নেই

বেক্সিমকোসহ বড় বড় কোম্পানিগুলোর ব্যালেন্স শিটে টাকা থাকলেও বাস্তবে তা দেশে নেই। সব টাকা বাইরে চলে গেছে। এই কোম্পানিগুলোর ২০, ৪০, এক লাখ শ্রমিকের বেতন দিতে হবে। কিন্তু তাদের একদিনেই সব বেতন দেয়া সম্ভব নয়। কথাগুলো বলেছেন, পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি আরো বলেছেন, মানুষের টাকা ব্যাংকে রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের টাকা বাইরে চলে গেছে। কিন্তু এই টাকা তো মানুষের। এখন ব্যাংকগুলো এবং মানুষের টাকার জন্য আমাদের সম্পদের দরকার। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে আগামী বছর আমরা রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার হয়তো দেখব। তখন দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে।

গতকাল শনিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চার দিনব্যাপী বার্ষিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট গাইন্ডারমিট এস গিল ‘দ্য মিডল ইনকাম ট্র্যাপ’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, সম্পদের অভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বেশি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু বৈষম্য কমাতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ গরিব মানুষদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। এই সরকার স্বল্পকালীন সময়ের জন্য এসেছে, তাই সব কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা এখন সম্পদের সঙ্কটে আছি। ফলে বিভিন্ন খাতে কাক্সিক্ষত বরাদ্দ নিশ্চিত করতে পারছি না।

তার মতে, মার্কেট ইকোনমিকে ইকুয়াল করতে হলে অনেকে এখন বলে, অর্গানাইজেশনাল ডেমোক্র্যাসি লাগবে। প্রান্তিক কৃষক বলি বা শ্রমিকের কথা বলি, তাদের অর্গানাইজেশনাল স্ট্রেন্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের চরের জমি দখল হয়ে যায়। হাওর অঞ্চলে অনেক জলাভূমি পড়ে আছে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা দরকার। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা এগুলো দখল করে নিয়ে যায়। স্থানীয়ভাবে এটা যদি শক্তিশালী থাকত অর্গানাইজেশনাল ডেমোক্র্যাসি, গ্রাসরুট ডেমোক্র্যাসি থাকত, তাহলে এখান থেকে অনেক রিসোর্স আসত। এটা যদি গরিবদের কাছে যেত, তাহলে অনেক লাভ হতো।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগেুলোকে আরো বেশি প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক হওয়া মানে শুধু চিপ লেবার, লো-টেকনোলজি না। এর বাইরে টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশন ও হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট দরকার। সেখানে ভূমিকা রাখবে শিক্ষা। দেশের শিক্ষা যে অবস্থায় আছে, এটা দিয়ে, এই মানবসম্পদ দিয়ে একদমই হবে না। পূর্ব এশিয়ায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নেয়, আর প্রায় ৭০ শতাংশ ভোকেশনাল শিক্ষার দিকে যায়। আমাদের দেশে ২০ শতাংশ যায় ভোকেশনাল শিক্ষায়। তাদের আবার যারা পড়াবে, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি, আছে মাত্র ২০ শতাংশ। অন্য দিকে জেনারেল এডুকেশনে প্রত্যেক জেলায় জেলায় বড় বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের।

উপদেষ্টা বলেন, আমরা ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ করব। কেউ বলছেন, এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আবার কেউ বলছেন, এখনই নয়। আমি এক সময় জাতিসঙ্ঘের এ কমিটিতে ছিলাম। আমরা যে অবস্থায় আছি, এতে এলডিসি উত্তরণের বিকল্প নেই। তবে আমরা যেটি করতে পারি, সেটি হলো এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলেও উন্নত দেশগুলোকে বলতে পারি যে, আমাদের সক্ষমতা এখনো বাড়েনি। তাই রফতানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ এবং জিএসপি প্ল্যাস সুবিধা যেন দেয়া হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আমরা রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই জিএসপি সুবিধা পাচ্ছি না।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমাদের শিল্পগুলোকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শুধু কম মজুরি, নিম্ন প্রযুক্তি ইত্যাদি দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখলে হবে না। পাশাপাশি সরকারের পক্ষে বিভিন্ন দেশের সাথে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের মতো অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করে ভিয়েতনাম আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তারা ৩০-৪০টি দেশের সাথে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করেছে। আমাদের এখনো একটি দেশের সাথেও এই অ্যাগ্রিমেন্ট হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে যুক্ত হতে না পারলে আমরা টেকসই উন্নয়ন করতে পারব না।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে উল্লেখ বিশিষ্ট্য অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, এমপিরা নিজ নিজ এলাকায় রীতিমতো জমিদার হয়ে যান। ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল।
গত তিনটি নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলে বর্ণনা করে তিনি বলেন, সেই নির্বাচনে নির্বাচিত এমপিরা আবার কেবল রাবার স্ট্যাম্পের মতো কাজ করতেন। ফলে অবসরে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজে সময় ব্যয় করেছেন।

রেহমান সোবহান বলেন, অসমতা পরিমাপের ক্ষেত্রে শুধু খানা আয়-ব্যয় জরিপের পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হচ্ছে; এর বাইরে কেউ যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আয়করের বিবরণী গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপে শীর্ষ আয়ের মানুষের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হলো ১০ লাখ টাকার সম্পদ ও মাসিক ৩০ হাজার টাকা আয়। এ সম্পদ এবং আয় গুলশান ও বারিধারার বেশির ভাগ গাড়িচালকেরই আছে। এই মানদণ্ড বিচার করা হলে আমাদের মতো অনেক মানুষই পরিসংখ্যান থেকে হারিয়ে যাবে। ফলে গবেষকেরা যা করছেন, তা মূলত আলংকারিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের।

ড. বিনায়ক সেন বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বৈষম্য বিরোধী মনোভাব আরো বড় হিসেবে তৈরি হয়েছে। সেই স্প্রিটকে সামনে রেখে বৈষম্য দূর করতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।

ইন্দরমিত এস গিল তার গবেষণাপত্রে বলেন, বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ মধ্য আয়ের ফাঁদে পড়ে আছে। প্রায় ৬০০ কোটি মানুষ এই ফাঁদের শিকার। তারা সময়ের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। এই মধ্য আয়ের ফাঁদ থেকে বাঁচতে হলে মেধা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং পুঁজির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

গিল বলেন, আপনাকে অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করতে হবে, বিশেষ করে যখন বিনিয়োগনির্ভর পর্যায় থেকে উৎপাদন-নির্ভর পর্যায়ে স্থানান্তরিত হয়েছেন। অন্যরা যা-ই করুক না কেন, এখানে বাংলাদেশকে আরো বেশি উন্মুক্ত হতে হবে। গতকাল থেকে শুরু হওয়া এ সম্মেলন আগামী মঙ্গলবার শেষ হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/19673488