সারা ভারত জুড়ে ভারতের শাসকদল বিজেপি কেন বাংলাদেশ বিরোধী উন্মাদনা সৃষ্টি করছে? কেন তাদের এই জিগিরের আছর পড়েছে তাদের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ওপর? কেন তাদের এই ধর্মীয় উন্মাদনায় ভেসে যেতে চলেছেন এক সময়কার অগ্নিকন্যা নামে খ্যাত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী? চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বাংলাদেশের একজন নাগরিক। হতে পারেন তিনি হিন্দু ধর্মের একজন সন্ন্যাসী। সেই সন্ন্যাসীকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করেছে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বাংলাদেশের পতিত হাসিনা সরকার তো অতীতে অনেককেই গ্রেফতার করেছিল বা তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনেছিল। বাংলাদেশে অতীতে হাসিনা জামানায় এমনও দেখা গেছে যে, ২০১৫ সালে একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেই নেতাকে ২২ মাস কারাগারে রাখা হয়েছিল। যতবার তার জামিনের আবেদন করা হয়েছিল প্রতিবারই সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ২২ মাস পর ঐ আওয়ামী জামানাতেই উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি জামিনের আবেদনের ওপর সরাসরি মন্তব্য করেছিলেন যে, সুদীর্ঘ ২২ মাস ধরে আপনারা একজন বন্দীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কোনো চার্জশীট প্রণয়ন তো দূরের কথা, একটি চিরকুটও দাখিল করতে পারলেন না। এরপর ঐ নেতা বা বন্দীকে কারাগারে রাখবেন আর কোন যুক্তিতে? অতঃপর তিনি ঐ নেতার জামিন মঞ্জুর করেন।
আগেই বলেছি যে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বাংলাদেশের একজন নাগরিক। গ্রেফতারের পর তার জামিন নামঞ্জুর হয়। আর এই জামিন নামঞ্জুর হওয়া নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায় এমন তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে যে তারা একজন মুসলমান আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করে। আইনজীবীর নাম সাইফুল ইসলাম আলিফ। অথচ বাংলাদেশী নাগরিক কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবিতে ভারতের সবগুলো রাজনৈতিক দল সমস্বরে সারাদেশে চিৎকার শুরু করেছে। এখন আর তারা চিন্ময় দাসের গ্রেফতারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটিকে একটি ছুতানাতা হিসেবে গ্রহণ করে তারা এইমর্মে ইন্ডিয়ার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে যে, বাংলাদেশে নাকি যেখানে সেখানে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে। ওরা যেভাবে উত্তর ভারত থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত বাংলাদেশের তথাকথিত হিন্দু নিধন নিয়ে তোলপাড় শুরু করেছে সেটা দেখে বাইরে থেকে মনে হবে যে, হিন্দুদেরকে বুঝি কচুকাটা করা হচ্ছে। এসব যে ডাহা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা সেটা কিছুক্ষণ পর আমরা কয়েকটি উদারহণ দিয়ে দেখাবো। কিন্তু এরমধ্যে তারা এই ইস্যু নিয়ে এমন সব কাণ্ড কারখানা শুরু করেছেন যে, মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে তারা বাংলাদেশ এ্যাটাক করবে।
এ নিয়ে সারা ইন্ডিয়াতে কী হচ্ছে দৈনিক সংগ্রামের সচেতন পাঠকরা সবই জানেন। তবুও কয়েকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। যেমন, কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে চরমপন্থী হিন্দুরা হামলা করেছিল। তারা হাইকমিশনের ভেতরে ঢুকতে পারেনি। তবে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা পুড়িয়েছে এবং ড. ইউনূসের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে। এরপর তারা আগরতলার বাংলাদেশী সহকারী হাইকমিশনে হামলা করেছে। সেখানে তারা হাইকমিশনের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ভাগ্য ভাল যে হাইকমিশনের বাংলাদেশী অফিসার এবং স্টাফদেরকে তারা প্রহার করেনি। তবে সেখানে তারা হাইকমিশনের পতাকা টেনে নামায় এবং সেটা পুড়িয়ে ফেলে। অবস্থা এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কলকাতা এবং আগরতলা থেকে বাংলাদেশের উপ হাইকমিশনার এবং সহকারী হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গণমাধ্যমে জল্পনা কল্পনা চলছে যে, ভারতের অন্যান্য রাজ্যে যেখানে বাংলাদেশের হাইকমিশনের শাখা রয়েছে তাদেরকেও হয়তো যে কোনো সময় প্রত্যাহার করা হতে পারে।
মানুষ ভেবে অবাক হয়েছেন যে, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার মমতা ব্যানার্জী এক উদ্ভট দাবি করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশে মোতায়েন করা হোক। এর জবাব বাংলাদেশকে দিতে হয়নি। জবাব দিয়েছেন শশী থারুর নামক একজন কংগ্রেস এমপি। তিনি ১৩ বছর জাতিসংঘে কাজ করেছেন। তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, জাতিসংঘের কার্যকলাপ বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করার নিয়ম কানুন সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জী কিছুই জানেন না। তিনি বলেন যে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে হলে যে দেশে মোতায়েন করা হবে সেই দেশের সরকারকে অনুরোধ করতে হবে যে আপনারা আপনাদের শান্তিরক্ষা বাহিনী আমাদের দেশে পাঠিয়ে দিন। এই রকম অনুরোধ জাতিসংঘকে তখনই করা হয় যখন সংশ্লিষ্ট দেশটির আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে এবং দেশটি একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
মমতা ব্যানার্জীর এই উক্তির জবাব দিয়েছেন একজন বাংলাদেশী নেতা। তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশে শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রেরণের পূর্বে ভারতের উচিত তার নিজ দেশের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, কাশ্মীর এবং উত্তর ভারতে শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রেরণের জন্য জাতিসংঘকে অনুরোধ করা। তাদের আরো উচিত মণিপুরে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা। আরো আছে। তাদের পাঞ্জাবে স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবি স্তব্ধ করার জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানো।
॥দুই॥
সকলেই জানেন, তারপরেও বলতে হচ্ছে যে, ভারতীয়রা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মুম্বাই, উত্তর প্রদেশ এবং তামিলনাড়ুতে বাংলাদেশের হিন্দুদের নির্যাতনের বানোয়াট অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শূন্যে গদা ঘোরাচ্ছে। তারা এতদূরও গিয়েছে যে, বাংলাদেশের অন্তত ৪টি জেলা দখলের জন্য ভারত সরকারকে সামরিক হামলার আহ্বান জানিয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতার নাম করে ওরা বলেছে যে, অবিলম্বে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য প্রেরণ করে হয় বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হোক, না হয় সেখানে ভারত বান্ধব সরকার প্রতিষ্ঠিত করা হোক। আর সেটাও যদি না করা হয় তাহলে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ফেনী দখল করা হোক। এই চারটি জেলা মিলে হয় স্বাধীন রাষ্ট্র করা হোক, না হয় ঐ চারটি জেলাকে ভারতভুক্ত করা হোক।
মুম্বাই, তামিলনাড়ু এবং উত্তর প্রদেশেও বিক্ষোভ করা হয়েছে। ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তে একদল ভারতীয় বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার হম্বিতম্বি করেছে। তবে বাংলাদেশ থেকে পাল্টা কয়েক শত ব্যক্তি সীমান্তে হাজির হলে ইন্ডিয়ানরা রণে ভঙ্গ দেয়। এগুলো ছাড়াও তো রয়েছে কয়েকটি রাজ্যের চরম ব্যবস্থা গ্রহণ। যেমন ত্রিপুরার কোনো হোটেলে বাংলাদেশীদেরকে রুম ভাড়া দেয়া হচ্ছে না। কলকাতার হাসপাতাল এবং কয়েকজন নামকরা ডাক্তার বাংলাদেশী রোগী ভর্তি করবে না অথবা বাংলাদেশী রোগী দেখবেন না। ঐদিকে আসামে হোটেল রেস্তোরাঁসহ প্রকাশ্যে গরুর গোস্ত খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বাস বলেছেন যে, কংগ্রেস যদি সমর্থন করে তাহলে তারা সমগ্র আসাম রাজ্যে গো হত্যা নিষিদ্ধ করবে।
॥তিন॥
ভারতের এই ধরনের উসকানিমূলক অপকর্মের ফিরিস্তি দিতে গেলে সেটি অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, পেট্রাপোল বর্ডারে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী যে সমাবেশ করেছেন সেটির প্রধান শ্লোগান ছিল, “দুনিয়ার হিন্দু এক হও”। এই দুনিয়ার হিন্দু বলতে তারা বাংলাদেশের হিন্দুদেরকেও বুঝিয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার সমর্থনে অনুষ্ঠিত আরেকটি সভার শ্লোগানটি ছিল আরো কৌতূহল উদ্দীপক। সেখানে শ্লোগান ছিল, “জয় শ্রীরাম” এবং “জয় শেখ হাসিনা”। এসব শ্লোগানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে সংঘ পরিবার এবং বিজেপি কোথায় ঠেলে নীচে নামাচ্ছে সেটি বোঝার মতো ক্ষমতাও আওয়ামী ওয়ালাদের ব্রেনে নেই।
লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, বিজেপি ভারতে এবং বাংলাদেশে যেভাবে আন্দোলনকে গুছিয়ে নিচ্ছে তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, আরএসএস মডেলে বাংলাদেশ বিরোধী পরিকল্পনা গড়ে উঠছে। মুম্বাইয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) সমাবেশ ও মিছিল করেছে। কর্নাটকে রাজ্যের প্রাক্তন উপ মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ নিয়ে যে বক্তৃতা করেছেন সেটিকে ‘হেট স্পিচ’ বা ঘৃণা করার বক্তৃতা বলে খোদ কর্নাটকের বিরোধীদল আখ্যায়িত করেছে। আসামের করিমগঞ্জ ও জকিগঞ্জে ভারত থেকে বাংলাদেশে রপ্তানির যে চালান আসছিল সেই চালানকে বাধাগ্রস্ত করেছে হিন্দুত্ববাদী কট্টর সংগঠনগুলো। আগেই বলেছি, ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তে হৈচৈ করা হয়েছে। এগুলোর উসকানি খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাদের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তাদের উসকানিমূলক উক্তির মাধ্যমে শুরু করেছেন।
হঠাৎ করে বাংলাদেশ বিরোধী এই উন্মাদনা কেন? উত্তর খুব সোজা। প্রথমত পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে ২০২৬ সালে তাদের বিধানসভা বা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে মমতাকে হটানোর জন্য বিজেপি মরিয়া। বিজেপির কাছে উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রচার ছাড়া খেলার আর কোনো তাস নেই। বাংলাদেশ যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের অভিন্ন সীমান্ত সন্নিহিত দেশ, তাই বাংলাদেশে হিন্দুদের নির্যাতনের হাইপ তুলে পশ্চিমবঙ্গেও তার ঢেউ ছড়িয়ে দেয়া। এব্যাপারে বিজেপি অনেকটাই সফল। কারণ মমতা ব্যানার্জী এবার বিজেপির পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন। ঐদিকে লোকসভাতে কংগ্রেসও একটু ক্ষীণ স্বরে হলেও একই আওয়াজ তুলেছে। আসল কথা হলো, মুসলমানদের প্রশ্নে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রশ্নে ভারতের সব রসুনের গোড়া এক।
॥চার॥
তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত দক্ষতা এবং দৃঢ়তার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন। বাংলাদেশের জন্মের ৫৪ বছর পর এই প্রথম এমন একজন নেতাকে পেয়েছে বাংলাদেশ যিনি প্রাথমিকভাবে অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু মাত্র ৪ মাসের দেশ পরিচালনায় তিনি দেখালেন, ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশের মতো আয়তনে অনেক ছোট কিন্তু দেশপ্রেমিক ১৭ কোটি মানুষকে সফলভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এই ঐক্য দেশের মধ্যে কাউকে কোণঠাসা করার জন্য নয়। বরং এই ঐক্য ভারতীয় আগ্রাসনকে মোকাবেলা করার জন্য।
ড. ইউনূস এটি কথা না বলে কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এই বাংলাদেশ শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার বাংলা নয়। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভের জন্য বাংলাদেশের জনগণ ভারতকে হস্তক্ষেপের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু এবার ভারত নিজেই এখন পর্যন্ত সামরিকভাবে না হলেও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে হানাদার। আর আওয়ামী লীগ হলো সেই হানাদার হিন্দুত্ববাদী ভারতের কোলাবোরেটার বা দালাল। জুলাই আগস্ট বিপ্লবে তাই আওয়ামী দালালরা ছাড়া ১৭ কোটি মানুষের আওয়াজ ছিল, “দিল্লী না ঢাকা/ঢাকা ঢাকা”।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ কোটি জনগণ ভারতকে মোকাবেলার জন্য ঐক্যবদ্ধ। ভারত যদি কোনো হঠকারী এ্যাডভেঞ্চার করতে চায় তাহলে এই ১৭ কোটি বিপ্লবী জনতার পাশে এসে দাঁড়াবে গণতন্ত্রকামী দেশসমূহ এবং মুসলিম জাহানের ভ্রাতৃবৃন্দ।