বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে দেশী-বিদেশী সংস্থার তৎপরতা শুরু হয়েছে। আমদানি-রফতানির আন্ডার ইনভয়েস বা ওভার ইনভয়েস ছাড়াও শেখ হাসিনার শাসনামলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে জনগণের আমানতের অর্থ নজিরবিহীনভাবে পাচার করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা। বিশ্বে বিরল এসব ঘটনা সরেজমিনে উদঘাটন করার অভিজ্ঞতা অন্যান্য দেশে কাজে লাগাতে চাচ্ছে বিশ্বের অনেক সংস্থা। আর এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকে আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা তথ্য উদঘাটন থেকে শুরু করে অর্থ উদ্ধারের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচিতিপত্র পাঠাচ্ছে। এ বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিক্রেট সার্ভিসের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে আসছেন শিগগিরই। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিনিধিরাও আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশে আসছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানেরই যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় তিন শতাধিক বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দখলে নেয়া ৮টি ব্যাংক থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই সরিয়ে নিয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার উপরে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগীরা দেশ থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার সরিয়েছে। এর মধ্যে এস আলম একাই সরিয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার। সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে কয়েকটি দেশে বিপুল অংকের অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। বিতর্কিত নাসা গ্রুপের যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। তেমনিভাবে বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধেও অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বিদেশী কয়েকটি বেনামী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল অংকের অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে। এসব তথ্য ইতোমধ্যে দেশী-বিদেশী সংস্থার মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়েছে। আরো অধিক তথ্য উদঘাটনের কাজ চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অগ্রাধিকারভিত্তিতে ১০টি বড় গ্রুপের অর্থ পাচারের বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়ে অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এস আলমের অর্থ পাচারের ঘটনা উদঘাটনের কাজ শেষ হয়েছে। এস আলমেরও দেশী-বিদেশী সম্পদ জব্দের অনুমোদন পাওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। পর্যক্রমে বাকি ৮টি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্য উদঘাটনের কাজ চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা রীতিমতো হতবাক হচ্ছে বিদেশী সংস্থাগুলো। তারা বাংলাদেশের অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো উদঘাটনের কাজে সম্পৃক্ত হতে অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে প্রায় অর্ধশত বিদেশী প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচিতিপত্র পাঠিয়েছে। কেউ কারিগরি সহায়তা করা, কেউবা অর্থ উদ্ধারের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পরামর্শক নিয়োগ পেতে আগ্রহপত্র পাঠিয়েছে। তবে, ওই সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের চৌকস সংস্থাগুলোকে প্রাথমিকভাবে সম্মতি দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্থ পাচারকারীদের পাকড়াও করতে বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ইউএস সিক্রেট সার্ভিসের সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। বিএফআইইউসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ৬০ জন প্রতিনিধিকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আগামী মাস থেকেই এ প্রশিক্ষণ শুরু হবে। এজন্য ইউএস সিক্রেট সার্ভিসের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে আসছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
অপর দিকে ইন্টারন্যাশনাল এন্টিকরাপশন কোঅর্ডিনেশন সেন্টারের প্রতিনিধি দল আগামী ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশে আসবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন সংস্থার সাথে বৈঠক করবেন। অপর দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এরও সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে আলোচিত ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে বিশদ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যক্তি অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে ওইসব স্থান চিহ্নিত করা হচ্ছে। মোট কথা যে কোনো উপায়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা হবে। পাশাপাশি অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধেও নেয়া হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আর এ জন্যই চৌকস টিম গঠন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাচারের অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে ব্যাংক খেকো এস আলম ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্তের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রথমে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এর পরের ধাপে আরো তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তৃতীয় ধাপে আরো পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাচার হওয়া সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পাচার করা একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতারণা, জালিয়াতি ও হুণ্ডির মাধ্যমে ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম, তার স্ত্রী ও সন্তানদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সূত্রে জানা যায়, এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন ও দুই ছেলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাসসহ ইউরোপে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করেছেন। এসব টাকা দিয়ে তারা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রয় ও ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। পাচারকৃত অর্থে সিংগাপুরে ২৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ক্যানালি লজিস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেছেন।
অপর দিকে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এ পর্যন্ত পাঁচ দেশে ৮ হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। শুধু যুক্তরাজ্যেই তার ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চারটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর বড় একটি অংশই পাচার করেছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বের হয়ে এসেছে। এর মধ্যে দুবাই, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড এই পাঁচ দেশেই বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।