লেবাননে প্রায় প্রতিদিনই বোমা ফেলছে ইসরাইলী বাহিনী। ফলে চরম আতঙ্কে দিন কাটছে সেখানে অবস্থান করা বাংলাদেশীদের। কর্মস্থল ছেড়ে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। জীবন বাঁচাতে দেশে ফিরতে চাইছেন শত শত বাংলাদেশী। এছাড়া মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ায় থাকা কয়েক হাজার প্রবাসী দেশে আসতে দূতাবাসে নাম নিবন্ধন করছেন।
প্রবাসীদের একটি সূত্র জানায়, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে লেবাননে অবস্থানের বদলে দেশে ফেরাকেই ভালো মনে করছেন বাংলাদেশীরা। ভুক্তভোগীরা জানান, লেবাননে ক্রমবর্ধমান ইসরাইল হামলার মুখে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন দক্ষিণ লেবাননে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা। হামলার তীব্রতা বাড়ছে বৈরুতেও। জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া ছাড়াও অনেকে চলে গেছেন অন্য কোনো শহরে। এরমধ্যে নিজাম নামে একজন বাংলাদেশি বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। লেবাননে ইসরাইলী হামলায় গত সোমবার পর্যন্ত তিনজন বাংলাদেশী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন। আহতদের মধ্যে দুজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ইমরান হোসেন নামে এক প্রবাসী জানান, আমরা এখানে খোলা আকাশের নিচে দিন যাপন করছি। আমরা সব সময় ভয় ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। এছাড়াও আরো কয়েক হাজার বাংলাদেশী এখন লেবানন থেকে দেশে ফিরে আসার আকুতি জানাচ্ছেন। বগুড়ার বাসিন্দা মাইনুদ্দিন মুঈন জানান, এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ইসরাইলী জঙ্গী বিমান বোমা নিক্ষেপ করছে। আমরা বেশির ভাগ প্রবাসী দক্ষিণ লেবাননে বসবাস করি। এখানে কয়েক হাজার বাংলাদেশী বসবাস করে। এই অঞ্চলেই বোমা নিক্ষেপ বেশি করা হচ্ছে। লেবাননপ্রবাসী আরেক বাংলাদেশী রফিকুল ইসলাম বলেন, পুরো রাজধানীতে সুনসান নীরবতা। গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। রাস্তাঘাটও ফাঁকা। অনেক বাংলাদেশী লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এসে বৈরুতে আশ্রয় নিয়েছেন। নানা কারণে অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে এখনো যেতে পারেননি। অনেক বাংলাদেশী দেশে ফিরতে চাইছেন, কিন্তু সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না।ফিরছেন ৫৩৭ প্রবাসী: যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ লেবানন থেকে রাতে দুই দফায় দেশে ফিরছেন ১৯৯ বাংলাদেশী। মঙ্গলবার রাত ১১টায় বৈরুতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে দুবাই হয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছাবেন তারা।
এছাড়া আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় অপর একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ১৬৭ জন দেশে ফিরবেন একই সময়ে। ফিরিয়ে আনা এসব প্রবাসীদের রাতে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাবেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব মো. রুহুল আমিন। এর আগে রোববার বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, অষ্টম দফায় লেবানন থেকে মঙ্গলবার রাত ১১টার পর ঢাকায় পৌঁছাবে ৩২ বাংলাদেশী। এখন পর্যন্ত সাত দফায় লেবানন থেকে দেশে ফিরেছেন ৩৩৮ জন। মঙ্গলবার রাতে দুই দফায় ১৯৯ জন দেশে ফেরার পর এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৩৭ জনে। এক বিজ্ঞপ্তিতে বৈরুতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, লেবাননে চলমান যুদ্ধপরিস্থিতির কারণে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় দেশে যেতে দূতাবাস বরাবর আবেদন করেছেন এবং যাদের পাসপোর্ট, আকামাসহ আবশ্যক ট্রাভেল ডকুমেন্টস প্রস্তুত রয়েছে, তাদের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চলতি বছরে লেবানন গেছে দ্বিগুণ: জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে লেবাননে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছিল। ২০২৩ সালে দেশটিতে কর্মী ভিসায় দুই হাজার ৫৯৪ জন পাড়ি দিয়েছিলেন, যার মধ্যে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গেছেন এক হাজার ৮৭০ জন কর্মী। সে তুলনায় চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত লেবানন পাড়ি জমিয়েছেন চার হাজার ২২৫ জন কর্মী। লেবাননে নিরাপত্তার শঙ্কা না থাকলে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা আরো বাড়ত বলে মনে করছেন অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। জানা গেছে, লেবাননে বর্তমানে ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো বাংলাদেশী অবস্থান করছে।
নিরাপদ স্থানে দুই হাজার বাংলাদেশী : লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বিমান হামলার পর বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি গত কয়েক দিনে বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাসের সূত্র জানায়, লেবাননের যেসব জায়গায় ইসরায়েল হামলা করছে সেসব জায়গা থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দূতাবাস এবং স্থানীয় বাংলাদেশ কমিউনিটি সহযোগিতা করছে। এরআগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈরুতের উত্তরে অথবা অন্য কোনো নিরাপদ এলাকায় অবস্থান নিতে বলা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত এক সপ্তাহ দক্ষিণ বৈরুতের কিছু এলাকায় ক্রমাগত বিমান আক্রমণ চালানো হচ্ছে। আক্রমণের ধারায় প্রতীয়মান হয় যে দাহি ও এর নিকটবর্তী এলাকায় বসবাস করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমন অবস্থায় যেসব বাংলাদেশি এখনো ওই এলাকায় অথবা এর অতি নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করছেন, তাদের অতিসত্বর ওই এলাকা ত্যাগ করে বৈরুতের উত্তরে অথবা অন্য কোনো নিরাপদ এলাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। বিজ্ঞপ্তিতে জরুরি প্রয়োজনে দূতাবাসের ফ্রন্ট ডেস্ক (৭১২১৭১৩৯), হটলাইন (৭০৬৩৫২৭৮) কিংবা হেল্পলাইন (৮১৭৪৪২০৭) নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
প্রবাসীদের আশ্রয় কেন্দ্র: এদিকে লেবাননের বিভিন্ন স্থানে ইসরাইলের বোমা হামলায় প্রবাসীরা একটি আশ্রয়কেন্দ্র তৈরী করেছে। রাজধানী বৈরুতের মোকাল্লেছ এলাকার এই আশ্রয়কেন্দ্রে প্রতিদিন অন্তত ৩০০ জনকে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জানা গেছে, এই আাশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়াদের বেশিরভাগই দক্ষিণ লেবাননের বাসিন্দা। বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় একটি বহুতল ভবন ভাড়া করে আশ্রয়কেন্দ্রটি তৈরী করা হয়। লেবাননের বিজনেস কমিউনিটির উদ্যোগে আশ্রয় কেন্দ্রের খাবার খরচসহ যাবতীয় ব্যয় বহন করছে স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।
নিহত নিজামের লাশ দেশে আনার আকুতি : বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাসের বরাত দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, শনিবার স্থানীয় সময় বিকাল ৩টা ২৩ মিনিটে হাজমিয়ে এলাকার একটি কফিশপে অবস্থানকালে বিমান হামলার শিকার হন বাংলাদেশি নিজাম। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, পাসপোর্ট অনুযায়ী নিজামের বয়স ৩১ বছর ১১ মাস। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস। মা মোসা. আনোয়ারা বেগম। নিজামের স্ত্রী লেবাননেই অবস্থান করছেন এবং দূতাবাস তার সাথে যোগাযোগ রাখছে। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় নিজামের লাশ বাংলাদেশে পাঠানো আপাতত সম্ভব হচ্ছে না বলে তাকে জানানো হয়েছে। নিজামের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলা খাড়েরা গ্রামে। তার মৃত্যুর খবর পৌঁছানোর পর পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছেন এবং পরিবারের সদস্যরা তার লাশ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। নিজামের বড় ভাই জালাল উদ্দিন বলেন, ভাইয়ের লাশ দেশে আনতে চাই। ভাইকে আমরা শেষবারের মতো দেখতে চাই। অনেক দিন ধরে ভাইকে দেখি না। শেষবারের মতো দেখতে চাই। এ জন্য সরকারের সহায়তা দরকার। দেশে গ্রামের কবরস্থানে ভাইয়ের লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে দিতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ জানাই। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে ৭ লাখ টাকা দেনা করে ১২ বছর আগে লেবাননে পাড়ি জমিয়েছিলেন নিজাম উদ্দিন। মায়ের থাকার জন্য একটি টিনের ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু এর ছয় মাস পর তাদের মাও মারা যান। খরচের কথা চিন্তা করে ১২ বছরে একবারও দেশে আসতে পারেনি তার ভাই। এবার দেশে ফেরার চিন্তা করছিলেন নিজাম, কিন্তু এখন সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।