৫ অক্টোবর ২০২৪, শনিবার, ৯:১১

এনআরবি ব্যাংকে অস্থিরতা, বাড়ছে খেলাপি ঋণ

রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড। লক্ষ্য ছিল বৈধ পথে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আনা। কিন্তু চেয়ারম্যানের একক নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। পর্ষদের অনৈতিক হস্তক্ষেপে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ এখনো চেয়ারম্যানের দখলে রয়েছে।

ফলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায়ও নানারকম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে। নামে-বেনামে ঋণ বিতরণ করায় তা আদায় হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করা ব্যাংকটির প্রথম প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন ইকবাল আহমেদ। তিন বছর পর ঘটনাক্রমে ২০১৬ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন প্রবাসী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান। এই পরিবর্তনের পর ইকবাল আহমেদসহ অনেক মূল প্রতিষ্ঠাতাকে ব্যাংকের পর্ষদ থেকে বাদ দেয়া হয়। পাশাপাশি অবৈধভাবে নামে-বেনামে ব্যাংকটির শেয়ার কিনেন মাহতাবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে ব্যাংকটিতে তার পরিবারের ৫ জন সদস্য সরাসরি পরিচালক হিসেবে আছেন। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, মাহতাবুর রহমান ও তার পরিবার ব্যাংকটির মোট ২৪.৪৩ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন। এর মধ্যে মাহতাবুরের স্ত্রী, তার দুই ভাগ্নে, এক ভাগ্নের স্ত্রী, দুই মেয়ে, ভাই, পুত্রবধূ। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, স্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন মাহতাবুর রহমান।

তার বিরুদ্ধে ব্যাংকটি থেকে অর্থ সরিয়ে তা পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। এতে ব্যাংকটি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়েছে। প্রতিষ্ঠার প্রথম তিন বছর ব্যাংকটিতে কোনো খেলাপি ঋণ না থাকলেও ২০১৬ সাল থেকে আগ্রাসী ব্যাংকিং করায় খেলাপি ঋণের তালিকায় নাম উঠে ব্যাংকটির। ওই সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট বিতরণকৃত ঋণের ১.৯ শতাংশ, যা বর্তমানে কয়েক গুণ বেড়ে ৫.৬৩ শতাংশ হয়েছে।

ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী- প্রতিনিয়ত বাড়ছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২.৪৬ শতাংশ, ৩.৭১ শতাংশ এবং ৪.১৪ শতাংশ। এরপর সেটা কিছুটা কমে ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.৭১ শতাংশ, ৩.৩৯ শতাংশ এবং ৩.২২ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালের শেষে তা আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৯৮ শতাংশ। সবশেষ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫.৬৩ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, যেখানে ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর পরিশোধিত মূলধন ৫৯০ কোটি টাকা। কর পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৭৯ কোটি টাকা।

গত ৫ই আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে ইমন হোসেন গাজী হত্যার অভিযোগে তার ভাই আনোয়ার হোসেনের করা মামলায় গত ১১ই সেপ্টেম্বর মাহতাবুর রহমান এবং নজরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি ব্যাংকখাতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট এবং অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এসব ব্যাংকের পর্ষদ ভাঙা হয়েছে। কিন্তু এনআরবি ব্যাংকেও একই ধরনের সমস্যা থাকলেও এখনো এই ব্যাংকটির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২০ সালে ব্যাংকের ৭ জন উদ্যোক্তা তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। সেই অভিযোগে চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান নীতি লঙ্ঘন করে ব্যাংকের উপর পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো, ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ক্ষমতা ক্ষুণ্ন্ন করা, গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা, ঋণ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও চেয়ারম্যান পদে আঁকড়ে থাকা এবং তার ব্যক্তিগত ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ব্যাংক ব্যবহার করার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল। অভিযোগ পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্তও শুরু করে। কিন্তু সরকারের উপর মহলের মাধ্যমে ওই তদন্ত বন্ধ করেন তারা।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান ব্যাংক কোম্পানি আইনের তোয়াক্কা না করে তার পরিবারের লোকজনকে দিয়ে বেনামে শেয়ার ক্রয় করিয়েছেন। আর এসব দুর্নীতি ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তেই ধরা পড়েছে।

একই সময়ে দুদকেও একটি অভিযোগ দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাহমুদ ইকবাল। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান।

সম্প্রতি বিএফআইইউসহ একাবিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান মাহতাবুর রহমানের অবৈধ সম্পদ, সোনা চোরাচালান, মানি লন্ডারিংসহ বিভিন্ন অপকর্মের তদন্ত শুরু করেছে।

সিঙ্গাপুর প্রবাসী উদ্যোক্তা পরিচালক মোহাম্মদ বদিউজ্জামান বলেন, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করি। ওই সময় যারা পরিচালক ছিল তাদের কৌশলে সরিয়ে দেন মাহতাবুর রহমান। এভাবে ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। আমার দায়িত্বকালীন শেষ এক বছর কোনো মিটিং করতে দেয়নি।

আরেক উদ্যোক্তা পরিচালক বলেন, পর্ষদের সদস্যরা সভায় হাজির হলে ৫ হাজার ডলার দেয়া হতো। কিন্তু সেখানে বিদেশ থেকে দেশে আসার প্লেন ভাড়া, হোটেল খরচ এসব ভাউচার দেখানোর নিয়ম ছিল। কিন্তু দেখা গেছে অনেকে দেশে থেকে জুমে মিটিং করে বছরে ৪ মিটিংয়ে ২০ হাজার ডলার আয় করেছে। কিন্তু এসব নিয়ে বলার কেউ ছিল না।

এনআরবি ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী, গত বছরের ১৮ই সেপ্টেম্বর অ্যালায়েন্স হাসপাতালের নামে ৫৫ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণের অনুমোদন হয়। হাসপাতালটি ভাড়া ভবন থেকে পরিচালিত হয়, ঋণের বিপরীতে তেমন কোনো জামানতও নেই। ঋণটির আদায় ইতিমধ্যে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। একইভাবে গত বছরের আগস্টে নতুন নিবন্ধিত হওয়া বরুণ করপোরেশনের ১৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়। এই ঋণও নিয়মিতভাবে ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি। গত আগস্টে বেলা অ্যাগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় ৪ কোটি টাকা। এই ঋণ ইতিমধ্যে অনাদায়ী হয়ে পড়েছে।

সার্বিক বিষয়ে এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমানের বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা শিখা বলেন, এনআরবি ব্যাংকের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে পর্ষদ ভেঙে দেয়ার বিষয়ে বিবেচনা করা হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=130308