৫ অক্টোবর ২০২৪, শনিবার, ৮:৪৩

মামলায় আটকে থাকা খেলাপি ঋণ উদ্ধারের ব্যবস্থা নিন

-ড. আর এম দেবনাথ

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অনেক কথা বলছেন, যা আমাদের অনুসরণ ও অনুধাবন করতে হবে। বোঝার চেষ্টা করতে হবে তিনি কী বলতে এবং কী করতে চাইছেন। এই যেমন ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি খবরে দেখলাম, তিনি বলেছেন, ‘৪-৫টি পরিবার ব্যাংক থেকে ২ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এতে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসতে পারত, সেটা হয়নি।’ কী মারাত্মক খবর! পুরো ব্যাংক খাতের সর্বমোট ঋণই হবে ১৫-১৬ লাখ কোটি টাকা! এর মধ্যে ৪-৫টি পরিবার নিয়ে গেছে ২ লাখ কোটি টাকা। এরই মধ্যে আবার বলা হচ্ছে, এতে যে মন্দা নেমে আসার কথা ছিল তা হয়নি। এ মন্দার কথাটি বোঝা গেল না। তাহলে কি ২ লাখ কোটি টাকা যেসব পরিবার নিয়েছে, তারা তা ‘প্রোডাকটিভ সেক্টরে’ বিনিয়োগ করেছে? এসবে বিনিয়োগ করলেই তো কোনো মন্দা হয় না। যদি টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করত, অথবা ‘ক্যাশ’ টাকা ধরে বসে থাকত, তাহলে এর প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হতে পারত। এমতাবস্থায় বিষয়টি সম্যক বোঝা গেল না। পত্রিকাগুলো কি তাহলে ঠিকমতো রিপোর্ট করতে পারেনি? নাকি গভর্নরের কথা তারা বোঝেনি? মুশকিল হচ্ছে, গভর্নর যদি এ কথা বলে থাকেন, তাহলে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দরকার।

প্রথম কথা, ৪-৫টি পরিবার নিয়েছে ২ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ এসব বড় ঋণ, খুবই বড় ঋণ নিয়েছে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রশ্ন, এরা কারা? কারা এত বড় প্রতিষ্ঠান, যারা এত বিশাল পরিমাণ ব্যাংকঋণ নিতে পারে? সত্যি কি দেশে এত বড় শিল্প-ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আছে, যারা এত পারিবারিক ঋণ নিতে পারে? ৪-৫টা পরিবার যদি ২ লাখ কোটি টাকা নেয়, তাহলে গড়ে পরিবারপিছু হয় ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা। এত টাকার কথা জানি না। তবে গভর্নর যেহেতু বলেছেন, তাহলে জেনেশুনেই তা বলেছেন। অবশ্য এ কথা এখন জানা যে, দেশে অনেক বড় বড় গ্রুপ/ব্যবসা আছে, ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ আছে। এদের নাম সবাই জানে। প্রতিদিন অমুক গ্রুপ, তমুক গ্রুপের খবর ছাপা হয়। যদিও এসব গ্রুপ অব কোম্পানিজের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এগুলো নামেই সার। সত্যি সত্যি ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ হতে হলে কোম্পানিগুলোকে হতে হবে ‘হোল্ডিং কোম্পানির’ অধীনস্থ সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। স্পষ্টত এসব ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ হোল্ডিং কোম্পানি ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানির কাঠামোতে আবদ্ধ নয়। তবু আমাদের দেশ এ ধরনের পরিচয় দেওয়া কোম্পানিতে ভর্তি। এতে গ্রুপের একটা কৃত্রিম আর্থিক শক্তি প্রকাশ পায়, যা কাম্য নয়। তবু এটা হয়ে আসছে। অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, এ মুহূর্তে দেশে কতগুলো ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ আছে, তা কেউ আমরা জানি না। তবে দৃশ্যত অনেক ‘গ্রুপ’ বড় গ্রুপ, তারা বড় বড় ব্যবসা করে। তাদের ব্যবসা আছে, শিল্প আছে। আছে আবাসনশিল্প, ব্যাংক, বিমা, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, সিমেন্ট কারখানা, চা বাগান। বস্তুত ছোট্ট এ অর্থনীতিতে ব্যাংকের সহজ অর্থায়নে তারা যে যেভাবে পারে, সেভাবে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। এতে ভালোই হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এদের নিজেদের ‘ইক্যুইটি’ কত, এবং কত লোন ব্যাংকের? এ হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে জানা যায় ৫-৭-১০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনী কোম্পানি ১০০ কোটি টাকার ‘এলসি’ খোলে। ট্রাস্ট রিসিপ্ট (টিআর) ফ্যাসিলিটি ভোগ করে। ভোগ করে অনেক ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি। অধিকাংশ কোম্পানিই পারিবারিক কোম্পানি। এরা স্টক একচেঞ্জে ‘এনলিস্টেড’ নয়। তারা লাভ ভাগাভাগি করতে রাজি হয়।

এ ধরনের বিগ বিজনেস দেশে প্রচুর হয়েছে গত ১০-১৫ বছরে। এরাই দেশের বিগ বিজনেস করছে। এরাই ব্যবসায়ী, এরাই রাজনীতিক, এরাই সংসদ-সদস্য, মাননীয় মন্ত্রী ইত্যাদি। এতে কোনো অসুবিধা নেই, যদি তারা নিজের পয়সায় ব্যবসা করত। অন্তত ঋণের টাকায় শুরু করে এক সময়ে গিয়ে ঋণ পরিশোধ করে দিত। কিন্তু না, তা হয়নি। তারা ব্যাংক থেকে ইচ্ছামতো ঋণ নিয়েছে। আমাদের সদাশয় ব্যাংকাররা মহাআনন্দের সঙ্গে তাদের ঋণের পর ঋণ দিয়ে বড় করছে আর নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলেছে। ব্যাংকের এমন সহজ ঋণ পেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা বাড়াতে বাড়াতে এমন পর্যায়ে গিয়ে পড়েছে যে, তারা এখন হয়ে পড়েছে ‘ওভার বরোড’ কোম্পানি। অর্থাৎ অতিরিক্ত ঋণী ব্যবসায়ী। তাদের পর্যাপ্ত ‘ক্যাশ ফ্লো’ নেই, যা দিয়ে ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারে। অনেক টাকা তারা বিদেশে পাচার করেছে। অনেক টাকা মাটিতে ঢেলেছে। ঢাকাসহ সারা দেশে শুধু বাগানবাড়ি, রিসোর্ট, কারখানার কথা বলে একরের পর একর জমি তারা দেশে কিনে রেখেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এদের কাছে কত টাকা আটকা আছে?

বড় বড় কোম্পানির কাছে মোট কত টাকা আটকা আছে, তার কোনো হিসাব আমার কাছে নেই। তবে কাগজে দেখলাম, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খারাপ ঋণ/শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণ/মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ১,৩৩,৭২২ কোটি টাকা। পুনঃতফশিলকৃত (রিশিডিউলড) ঋণের পরিমাণ ছিল ২,৮৮,৫৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুনঃকাঠামোকৃত (রিস্ট্রাকচারড) ঋণও আছে। তারপর ‘রিটেইন অফ ঋণে’র পরিমাণ ছিল ৫৩,৬১২ কোটি টাকা। সব মিলে হয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যেখানে মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণই হবে মাত্র ১৫-১৬ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ ঋণই খরচের খাতায় এবং এর বড় একটা অংশ বড় বড় গ্রাহকের কাছে। ৫/১০/১৫/২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা অনেক। একেকটি পার্টি ৫/১০/১৫/২০ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। সবই কিন্তু নিয়ম মেনে নিয়েছে, না হয় আধা মেনে নিয়েছে, না হয় প্রভাব খাটিয়ে নিয়েছে। নিয়ে এখন সবাই যে আনন্দে আছে, তা নয়। তাদের অনেকের অবস্থা খারাপ। বড় বড় গ্রুপ ভীষণ দুর্দশায় মধ্যে আছে। এটা কেন হয়েছে?

এর প্রধান কারণ আমাদের ফিন্যান্সিং ও শিল্পায়ন নীতি। দেশের লোকের পুঁজি নেই, মূলধন নেই। পুঁজি আসবে কোত্থেকে? ব্যাংক থেকে। কিছু লোককে টাকা ধরিয়ে দাও। তারাই করবে শিল্প-ব্যবসা, দেশে হবে শিল্পায়ন। একেই বলে ‘ব্যাংক ফিন্যান্স লেড গ্রোথ’ মডেল। এখানে স্টক এক্সচেঞ্জের কোনো ভূমিকা নেই। আমরা বরং স্টক এক্সচেঞ্জকে ব্যাংকের মতোই লুটের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছি। ‘ব্যাংক ফিন্যান্স লেড গ্রোথ’ মডেলের ফল হচ্ছে আজকের অবস্থা। এটা আবার বাজার অর্থনীতি। এই অর্থনীতিতে সবাই টিকতে পারবে না। বড়রা টিকবে, ছোটরা বিলীন হবে। বাংলাদেশের ব্যবসার ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, গত ৫০-৫২ বছরে আমাদের পুরোনো নামকরা প্রতিষ্ঠান সব ভেস্তে গেছে। এর স্থলে জেগে উঠেছে রাজনৈতিক ছায়ায় কতগুলো গ্রুপ এবং তারা সবাই আজ ‘ওভার বরোড গ্রুপ’। স্টিল, সিমেন্ট, রড, ওষুধ, আবাসন, নির্মাণ, চা, চিনি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে রয়েছে ওভার বরোড কোম্পানি। এখন কাজ কী? প্রশ্নটি করছি, কারণ সরকার দেখা যাচ্ছে ব্যাংক কমিশন না করে ব্যাংকিং টাস্কফোর্স করেছে। তাদের হাতে কত সময় আমরা কেউ জানি না। অথচ ব্যাংকিং টাস্কফোর্সের হাতে কাজ অনেক বেশি। আমি তো মনে করি, এদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত দেশে যত অর্থঋণের মামলা আছে, তা জরুরি ভিত্তিতে ফায়সালা করা। হাজার হাজার মামলা কোর্টে ঝুলে আছে দিনের পর দিন। উকিল নেই, বিচারক নেই। ঝুলে আছে। ‘টাস্কফোর্সের’ বসা উচিত ব্যাংকের সঙ্গে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব মামলার ফয়সালা দরকার। দরকার হলে জরুরি ভিত্তিতে জজ নিয়োগ করা হোক। ‘স্পেশাল বোর্ড’ গঠন করা দরকার। এসব মামলা ধরে এগোলে একটা ফল পাওয়া যাবে। বড় বড় পুনঃগঠিত ঋণের পুনঃমূল্যায়ন দরকার। যারা বড় বড় ঋণ নিয়েছেন, তারা ওই টাকায় ইন্ডাস্ট্রি করেছেন, নাকি ব্যবসা করছেন, তা দেখা দরকার। মর্টগেজ সম্পত্তি আছে কিনা, আমদানি-রপ্তানি ঠিক আছে কিনা, তা দেখা দরকার। প্রতিটি কেইস পরীক্ষা করা দরকার। দরকার হলে অডিটিং ফার্ম সঙ্গে নিন। দেখা দরকার তারা টাকা পাচার করেছে কিনা। তারা নিয়মিত কর দিচ্ছে কিনা, সরকারের পাওনা পরিশোধ করছে কিনা।

এসব করা দরকার, কারণ গভর্নর সাহেব বলেছেন, বড়রা বড় বড় ঋণ নেওয়ার পরও দেশে মন্দা তৈরি হয়নি। তার কথাটি অনেকটা ইতিবাচক। যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে এসব ব্যবসা রক্ষা করা দরকার। দেখা গেছে, নতুন করে অনেক বড় বড় ব্যবসা পথে বসতে যাচ্ছে। এটা অশনিসংকেত। এতে খেলাপি ঋণ কমা তো দূরের কথা, বরং বাড়বে। এ বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। অবশ্যই একটা কথা বলা দরকার। এই বড় বড় শিল্পের সেবা করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো প্রমাণ করেছে তারা গরিবের বা মধ্যবিত্তের বন্ধু নয়, তারা ধনীদের বন্ধু। ব্যাংকগুলো অর্থ পাচারের হাতিয়ার। টাস্কফোর্সকে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। ভবিষ্যতে ব্যাংকগুলো যাতে ছোট ও মাঝারি ঋণে উৎসাহিত হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এখানে অবশ্য নীতিগত প্রশ্ন আছে। আমরা শিল্পপুঁজির জন্য, শিল্পে অর্থায়নের জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। শিল্পঋণ, শিল্প ঋণসংস্থা নামে দুটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এ দুটিকে এক করে বাণিজ্যিক ব্যাংক করেছি। করে শিল্পের অর্থায়ন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। শিল্পায়নে পুঁজি সরবরাহের জন্য স্টক এক্সচেঞ্জ করিনি। বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে পারিনি। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো হয়ে পড়েছে বড় বড় শিল্পমালিকদের লুটের আখড়া। সম্ভবত, অনেক দেশই এই মডেল অনুসরণ করে এখন পস্তাচ্ছে। আমার ধারণা, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা মোটামুটি পুঁজির মালিক হয়েছেন। দেশে-বিদেশে তাদের মূলধন আছে। তারা এখন অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজেদের পায়ে এখন তারা নিজেরা দাঁড়াক। তাদেরকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরানো হোক। যতদিন ব্যবসা-শিল্পমালিকরা বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর টাকার জন্য ভর করে থাকবেন, ততদিন খেলাপি ঋণের সমস্যা যাবে না। এসব করে বরং ছোট ও মাঝারি ঋণের প্রতি নজর দেওয়া দরকার। আঞ্চলিক দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংকগুলোকে ঢাকা থেকে মফস্বলে নিয়ে যাওয়া হোক। যেমন ‘সাউথ বাংলা’ ব্যাংক। ঢাকায় কেন থাকবে, নামই তার ‘সাউথ বাংলা ব্যাংক’। তারা ‘সাউথ বাংলায়’ ব্যবসা করুক, বিশেষ নজর দিক। ‘মার্কেন্টাইল ব্যাংক’ শিল্পে আসবে কেন? নামের কাজই করা উচিত। এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.jugantor.com/tp-ub-editorial/861068