সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে সরিয়ে নেয়া গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্যটি অ্যানেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। শনিবার রাত আটটা থেকে পুনঃস্থাপনের কাজ শুরু হয়। রাত দেড়টায় পুরো কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভাস্কর মৃণাল হক। সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই এটি পুন:স্থাপন করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়া হয়। এর ৪৮ ঘণ্টা পর শনিবার রাত দেড়টায় অ্যানেক্স ভবনের সামনে এটি পুনঃস্থাপন করা হলো। এ সময় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মাদরাসার ছাত্ররা প্রতিবাদ করায় তাদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
এদিকে এ মূর্তিটি পুনঃস্থাপন করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে ইসলামী সংগঠনগুলো। হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী বলেছেন, গত ২৫ মে মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণের মাত্র দুই দিনের মাথায় শনিবার দিবাগত রাতে সুপ্রিমকোর্ট অ্যানেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপন করা অত্যন্ত হতাশাজনক। গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। এই ঘটনায় তিনি মর্মাহত জানিয়ে বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক চেতনার পরিপন্থী এই বিদেশি ভাস্কর্যকে বাংলাদেশের কোথাও স্থান দেয়া যাবে না।
এদিকে মূর্তি পুন:স্থাপন করায় প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, ‘একজন প্রধান বিচারপতি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু ভাস্কর্য বনাম মূর্তি নিয়ে তার আচরণে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তিনি বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন বলে অনুমেয়। এতে জাতি হতাশ। কাজেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি (প্রধান বিচারপতি) পদত্যাগ করে জাতিকে মুক্তি দেবেন বলে আশা করি।’
অনতিবিলম্বে সুপ্রীম কোর্ট এনেক্স প্রাঙ্গণ থেকে গ্রীক দেবীমূর্তি সরানোর জন্য জোর দাবী জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ উলামায়ে কেরাম। তাঁরা বলেন, গ্রীক দেবীমূর্তি ন্যায় বিচারের প্রতীক মানলে মুসলমানদের ঈমান তথা মুসলমানিত্ব থাকবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও মন্ত্রীপরিষদে সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও এখনও উক্ত মূর্তি সাময়িক সরায়ে রেখে এনেক্স ভবনের সামনে তা পুন:স্থাপন করে মুসলিম উম্মাহকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। যা জঘন্য ধৃষ্টতা ও সেরা তামাশা। মূর্তি স্থাপন, মূর্তি পূজা ইসলামে চিরতরে হারাম ও জঘন্যতম শিরক। এ সত্য জানার পরও ৯৫ ভাগ মুসলমানের এ দেশের সর্বোচ্চ আদালত চত্বরে মূর্তি স্থাপন করে ইসলামের দুশমনরা সরকার, দেশের বিচারব্যবস্থা ও ইসলামপ্রিয় জনতাকে মুখোমুখী দাঁড় করাতে চায়। ইসলামের আক্বীদা ও বিশ্বাসকে সামনে রেখে সর্বোচ্চ আদলত থেকে মূর্তি অপসারণ করতেই হবে। অপসারণের ক্ষেত্রে অনমনীয় মনোভাব পোষণ করলে দেশ ক্রমশঃ দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হামাঙ্গা, হানাহানি, সংঘর্ষ ও সঙ্ঘাতের দিকে যেতে পারে। দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশিল হয়ে উঠার আগেই এ সমস্যা সমাধানে সরকারের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত বলে আমরা মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও কোন্্ খুঁটির জোরে ষড়যন্ত্রকারীরা মূর্তি সরিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলায় মেতেছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
শীর্ষ উলামায়ে কেরাম বলেন, মূর্তি থাকবে মন্দিরে। কোন দর্শণীয় স্থানে মূর্তি রাখা যাবে না। আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমিতে কালের পর কাল বিভিন্ন মূর্তি তাদের মন্দিরেই নিরাপদে গচ্ছিত রাখা হতো। মুসলিম উম্মাহ কোনভাবেই অন্য ধর্মের ধর্মীয় অধিকার হরণ করেনি, ভবিষ্যতেও কোন দিন করবেও না। বরং জীবন বাজী রেখে সকল ধর্মের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করতে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে।
শীর্ষ উলামায়ে কেরাম আরো বলেন, মূলত: কতিপয় অশুভ শক্তি দেশকে অস্থিতিশীল করতেই মূর্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর অনৈসলামী চিন্তা-চেতনা চাপিয়ে দিতে ব্যাপক প্রভাব খাটাচ্ছে। মূর্তি স্থাপনের কারণে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বিশ^নবী রাসূলের (সা.) আদর্শবাদিতার উপর নাস্তিক্যতা ও পৌত্তলিকতার গভীর আঘাত করা হয়েছে। সুতরাং কারো কূপ্রভাব, প্ররোচনায় ও চোখ রাঙানো নয়, ঈমানী তাগিদেই মূর্তি অপসারণ করতে হবে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সম্বলিত যে কোনো কাজ জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। দেশে বর্তমান আইনেও এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ।
শীর্ষ উলামায়ে কেরাম ২ জুন জুমুয়াবার দেশের সকল মসজিদ থেকে প্রতিবাদ করার জন্য খতীবদের প্রতি আমরা আহবান জানাচ্ছি। সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে ঈমানী ও নৈতিক অধিকার আদায় করা হবে ইনশাল্লাহ।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- শাইখ আবদুল মোমিন, মাওঃ মোহাম্মাদ ইসহাক, হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হজুর, মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী, অধ্যক্ষ মাওলানা যাইনুল আবেদীন,মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানী, ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী, শাহতলীর পীর মাওঃ আবুল বাসার, ফরায়েজী আন্দোলনের আমীর মাওলানা আব্দুল্ল¬াহ মোঃ হাসান, ইসলামী কানুন বাস্তবায়ন পরিষদের আমীর মাওলানা আবু তাহের জিহাদী, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, হক্কানী পীর মাশায়েখ পরিষদের মহাসচিব মাওঃ শাহ আরিফ বিল্ল¬াহ সিদ্দীকি প্রমুখ।
শনিবার রাতে গ্রীক দেবীর মূর্তি সুপ্রিমকোর্ট এনেক্স ভবনের সামনে প্রতিস্থাপনে বিস্ময় প্রকাশ করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান ও মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, গ্রীক দেবীর মূর্তি সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে সরিয়ে এনেক্স ভবনের সামনে স্থাপন সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের সঙ্গে খেল-তামাশার শামিল। ইসলামী জনতার সঙ্গে খেল-তামাশার পরিনতি ভালো হবে না। দেশের আলেম-উলামা ও ইসলামী জনতা থেমিচ মূর্তিকে চিরতরে পরিত্যাগ করার আহবান জানিয়ে আসছিলেন। মুসলমান মূর্তির সঙ্গে আপস করতে পারে না। অবিলম্বে মূর্তি সরান অন্যথায় যে কোনো পরিস্থিতির দায় দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। রমজান মাসেই সত্য ও মিথ্যার লড়াই তথা বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সুতরাং বদরের চেতনা নিয়ে মূর্তি উৎখাতে মুসলমান জীবন দিতেও প্রস্তুত। নেতৃদ্বয় আরো বলেন, ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে মূর্তির বিরুদ্ধে প্রেসক্লাবের সামনে ছাত্র জনতা আন্দোলনে নামলে তাদের উপর পুলিশ লাঠি চার্জ এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। মুসলমানদের ভ্যাট ও ট্যাক্সের টাকায় বেতন নিয়ে মুসলমানদের সঙ্গে এধরণের আচরণ কোনো ভাবেই সহ্য করা যায় না। নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে গ্রেফতারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার দাবী জানিয়েছেন।
ইসলামী ছাত্র মজলিস : গতকাল বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে গ্রীক মূর্তি প্রতিস্থাপনের প্রতিবাদে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস ঢাকা মহানগরী উত্তরের উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নেতৃবৃন্দ বলেন, গ্রীক মূর্তি অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র জনতা আন্দোলন চালিয়ে যাবে। আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের বর্বরচিত হামলার তীব্র নিন্দা ও গ্রেফতারকৃতদের মুত্তির দাবী জানানো হয়। তারা বলেন, কঠিন থেকে কঠিন আন্দোলনের মাধ্যমে মূর্তি ধ্বংস করতে বাধ্য করা হবে। মহাগর উত্তর সভাপতি মুহাম্মদ শাহিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা এনামুল হক মুসা, মাওলানা আজিজুর রহমান হেলাল, সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ রহমত আলী, প্রশিক্ষণ সম্পাদক মুহাম্মদ সাইদুর রহমান সানী, মুহাম্মদ ফাবাস্সির প্রমূখ।
খেলাফত আন্দোলন: খেলাফত আন্দোলন ঢাকা মহানগর আমীর মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, নায়েবে আমীর মাওলানা ফিরোজ আশরাফী, সাধারণ সম্পাদক হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, যুগ্ম সম্পাদক হাফেজ মাওলানা মাহবুবুর রহমান এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, রমযানের পূর্বমুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে গ্রিক মূর্তি অপসারণ করায় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। সেই সাথে এই মূর্তিকে যাতে আর কোথাও স্থাপনের মাধ্যমে প্রহসন না করা হয় সেই দাবিও জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার এদেশের ৯৫ ভাগ মানুষের চিন্তা- চেতনা ও বিশ্বাসের গভীরতা থেকে উৎসারিত সেই গণদাবিকে উপেক্ষা করে থেমিসের মূর্তিকে সূপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপন করেছে। এটা জনগণের সাথে উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, রমযানের প্রথম তারাবীর পরপরই গ্রিক মূর্তি পুন:স্থাপনের খবর তৌহিদী জনতাকে গভীরভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ করেছে। আমরা বরাবরই বলে আসছি গ্রিক মূূর্তি কখনো ন্যায়বিচারের প্রতিক হতে পারে না। অবিলম্বে এই মূর্তিকে সম্পূর্ণরূপে অপসারণ না করলে তৌহিদী জনতা এর বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলবে।