বিদ্যুৎ খাতে চরম লুটপাট চালিয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। বিশেষ করে শেখ হাসিনার শেষ ৩ বছর চলে লুটাপাটের মহোৎসব। এর মধ্যে বিদ্যুৎ না নিয়েই পাঁচ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের বিল পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিল পরিশোধ করা হয়েছে গত অর্থবছরে ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে উদ্যোক্তাদের এ অর্থ দেয়া হয় আলোচ্য সময়ে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাহিদা না থাকলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। আর এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগ সময়েই বসিয়ে রাখা হচ্ছে। এতে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এভাবে পিডিবির গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আর এ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লোকসান কমাতে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যার দায় জনগণকে নিতে হচ্ছে।
জানা গেছে, ঘনঘন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে বাড়তি ব্যয় মেটানো যায়নি। এতে লোকসানের পাল্লা ভারী হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। ভর্তুকির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে হাসিনার ক্ষমতার শেষ তিন অর্থবছরেই (২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪) পিডিবি লোকসান গুনেছে এক লাখ ৩১ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। আর সে ঘাটতি পূরণে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে এক লাখ সাত হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। অথচ আগের ১৩ বছরে পিডিবি লোকসান গুনেছে ৭৭ হাজার কোটি টাকা। আর সে সময় ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ৬২ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। এ থেকেই বোঝা যায় বিদ্যুৎ খাতের শেষ তিন বছরের চিত্র।
পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, কুইক রেন্টাল ও অন্য সব রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, তাদের চুক্তি অনুযায়ী এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিতে না পারলে তার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে। এখানে কোনো কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী উৎপাদন সক্ষমতা না থাকলেও অথবা বিদ্যুৎকেন্দ্র নষ্ট থাকলেও তা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা প্রতি বছর যাচাই করার কথা। আর সে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়। প্রতি বছর এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা যাচাই করা হয় কি না তা জানা নেই। অর্থাৎ এখানে বড় ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলছে। তবে তার জানা মতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই পুরনো। আর উৎপাদন সক্ষমতা যতটুকু দেখানো হয় ততটুকু নেই বলে তিনি মনে করেন।
বিডি রহমত উল্লাহ উল্লেখ করেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রকৃত চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট। পুরো গরমে ১২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়নি। আর বর্তমানে শীতের সময় তা ৭ হাজার মেগাওয়াটে নেমে এসেছে। তাই যদি হয় তাহলে এ ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কেন এখনো চালু রাখা হচ্ছে? আর কেনইবা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে জনগণের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে কিছু বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীর পকেটে দেয়া হচ্ছে। এটা নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে বলে তিনি মনে করেন।
বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন কম হওয়ায় বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইনের আওতায় এক সময়ে উচ্চ মূল্যের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। ২০১০ সালে বলা হয়েছিল এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র আপৎকালীন চাহিদা মেটানোর জন্য। তিন বছর পর বিদ্যুৎ নিয়ে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল থেকে আর বিদ্যুৎ নেয়া হবে না। সময়ের প্রয়োজনে এ সিদ্ধান্ত অনেকটা দায় টেকা সাধুবাদ পেলেও এটি এখন দেশ ও দেশের জনগণসহ সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য গলার কাঁটা হয়ে গেছে।
জানা গেছে, তিন বছরের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গত ১২ বছরেও বন্ধ করা যায়নি। এতে এ খাতে ব্যয় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আর এ ব্যয়ের দায় জনগণের ঘাড়ে চেপে বসেছে। গত ১২ বছরে আট দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আরেক দফা বাড়ানোর জন্য সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়ে গেছে।
এ দিকে পিডিবির হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা কয়েক গুণ বেড়ে ২২ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। কিন্তু চাহিদা ওই হারে বাড়েনি। ফলে উৎপাদন সক্ষমতার ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎও ব্যবহার হচ্ছে না। কিন্তু এরপরেও উচ্চ মূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখা হচ্ছে। আর বিদ্যুৎ নিতে না পারলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কোটি কোটি টাকা জনগণের পকেট থেকে কিছু বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীর পকেটে চলে যাচ্ছে।
পিডিবির গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ নিতে না পারলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিশোধ করা হয়েছে বিদায়ী বছরে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। বিদায়ী বছরে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ পরিমাণ অর্থের বিদ্যুৎ না নিয়েও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পরিশোধ করা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরেও পিডিবিকে ৬ হাজার ২৪১ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। ওই অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে মোট প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনা হয়েছিল। তেমনিভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকার এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে।
পিডিবির গত ৫ বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ফি বছরই ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়ছে। যেখানে কমার কথা ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালগুলোর বেশির ভাগেরই উৎপাদন সক্ষমতা আগের মতো নেই। কিন্তু বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে উৎপাদন সক্ষমতা আগের মতোই রেখে দিন দিন ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়িয়ে নিচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতা কমলেও বেসরকারি বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের ব্যয় কমছে না, বরং দিন দিন বেড়ে চলছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনোটির প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয়বারে চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে।
পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী সাঈদ আহমেদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ দিন দিন বেড়ে যাবে। কারণ বেসরকারি খাতে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে। তাদের তো এ জন্য একটি বিনিয়োগ আছে। এ কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে যাবে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়ার পরেও কেন নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হচ্ছে, এ বিষয়ে পিডিবির চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা ১৯ হাজার মেগাওয়াটের চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু গত বছর গরম কালে আমরা সর্বোচ্চ নিয়েছি ১৩ হাজার মেগাওয়াট। চলতি বছরে গরমকালে তা সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটে চলে যাবে। এ ছাড়া রিজার্ভ উৎপাদন সক্ষমতা রাখা হয়। যেমন, কোনো কোনো দেশের শতভাগ বিদ্যুতের রিজার্ভ সক্ষমতা রয়েছে। আমাদের যে উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে তার মধ্যে কিছু কিছু আছে অতি পুরনো। তা হলে কুইক রেন্টালের নির্ভরতা কেন কমছে না, এ বিষয়ে পিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, দুই একটি বাদে বেশির ভাগই আর চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে না। যেগুলোর বাড়ানো হচ্ছে তাদেরকে বলা হচ্ছে, ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে না। এর পরও বেসরকারি খাতে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র আসায় ক্যাপাসিটি চার্জ দিন দিন কমবে না, বরং বেড়ে যাবে।
পিডিবির তথ্যমতে, তিন অর্থবছর আগেও বিদ্যুৎ খাতের এ ধরনের চিত্র ছিল না। ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির লোকসান হয়েছিল ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সে অর্থবছর সংস্থাটিকে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল আরও অনেক কম। ওই (২০২০-২১) অর্থবছর পিডিবির লোকসান হয়েছিল সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আর ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল সাত হাজার ৪৩৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এদিকে ২০০৮-০৯ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনেছিল মাত্র ৮২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। পরের (২০০৯-১০) অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তবে ২০১০-১১ অর্থবছর লোকসান এক লাফে সাতগুণের বেশি বেড়ে হয় চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা আরও ৪৪ শতাংশ বেড়ে হয় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
পরের দুই অর্থবছর পিডিবির লোকসান আবারও বাড়ে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছর লোকসান ৩৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রায় সাত শতাংশ বেড়ে হয় সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পিডিবির লোকসান প্রায় ৪৭ শতাংশ কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর পিডিবির লোকসান আবারও বাড়ে। ওই অর্থবছর লোকসান দাঁড়ায় চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবির লোকসান অনেকখানি বাড়ে। ওই অর্থবছর ১১০ শতাংশ বেড়ে সংস্থাটির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তবে পরের দুই অর্থবছর তা আবার কমে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর লোকসান হয় আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর তা আরও কমেছিল। সংস্থাটির লোকসান প্রথম ১০ হাজার কোটি ছাড়ায় ২০২০-২১ অর্থবছর। যদিও পরের দুই অর্থবছরে তা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।