২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৩:১৮

অধিকাংশ দলই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ভয়মুক্ত নির্বাচনের পক্ষে

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৯তম অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন। দীর্ঘ ভাষণে তিনি গত আওয়ামী লীগ সরকারের অনিয়ম, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি বর্তমান সরকারের নেয়া বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়ে কথা বলেন। ভাষণে তার দেয়া বক্তব্যের মধ্যে সবার আগ্রহ ছিল নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে। বক্তৃতায় ড. ইউনূস বলেন, দেশের মানুষ তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে এটাই আমাদের লক্ষ্য। অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তবে এই ভাষণে দিনক্ষণ বা কখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে তা নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। যদিও এর আগে গত বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে সংবাদ ও গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে মতবিনিময়কালে বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার ১৮ মাস পর দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

জানা গেছে, আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশের বেশ কিছু রাজনৈতিক দল প্রতিনিয়ত বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, মানুষের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে এবং নির্মম অতীত যেন আর ফিরে না আসে, সেজন্য তারা কিছু সুনির্দিষ্ট খাতে সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সেই লক্ষ্যে বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠন করেছে। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের সংস্কারের জন্যও পৃথক কমিশনসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব সংস্কার যেন টেকসই হয়, তা দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
সূত্র মতে, অন্তর্বর্তী সরকার যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগের কথা বলছে, সেসময় সেনাপ্রধান দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি সময়ের কথা জানান। তার বক্তব্যে সবাই একটি ধারণা পায় যে, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। দেশে যাতে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে, সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থনের অঙ্গীকার করেছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। সম্প্রতি ঢাকায় নিজ কার্যালয়ে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধানের এ বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কারণ কতদিন পর দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা কৌতূহল ও প্রশ্ন রয়েছে। সেনাপ্রধানের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে মানুষের কৌতূহলের অবসান হবে।

নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেছেন, সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসনে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে ছয়টি কমিশনও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য প্রধান উপদেষ্টা বা অন্য কোনো উপদেষ্টার কাছ থেকে আসেনি। এ প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধানের বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন রাজনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা। আশা করা যায়, দেড় বছর পর দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এ প্রক্রিয়ায় দেশে গণতান্ত্রিক শাসন চালু হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দুটি রোডম্যাপ চেয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা বলছি, একটি রোডম্যাপ দিলে হবে না। দুটি রোডম্যাপ দিতে হবে। প্রথম রোডম্যাপটি হবে সংস্কারের। কী কী বিষয়ে সংস্কারের কাজ ওনারা করবেন। আর দ্বিতীয়টি হবে সংস্কারের সময়সীমা নিয়ে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াত আয়োজিত এক আইনজীবী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথাগুলো বলেন।

শফিকুর রহমান বলেন, এটা (রোডম্যাপ) যদি সফল হয়, তাহলে দ্বিতীয় রোডম্যাপটাও সফল হবে। প্রথমটা যদি সফল না হয়, দ্বিতীয়টার প্রয়োজনই নেই। ওটা দিয়ে কিছুই হবে না। আর প্রথমটা ঠিক করার জন্য অবশ্যই এ ব্যাপারে অংশীজন যারা আছেন, রাজনৈতিক অংশীজন যারা আছেন, সিভিল সোসাইটি, অন্যান্য যারা আছেন, তাদের সঙ্গে ঐকমত্যে আসতে হবে যে, এই বিষয়ে সংস্কার হবে এবং এই টাইমলাইনে সংস্কার হবে। তিনি আরও বলেন, এটা যখন একটি পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে দিতে হবে। আর দেরি করা যাবে না। কারণ, নির্বাচনের দিকে যাওয়া মানে গণতন্ত্রের দিকে ফিরে আসা। দেশে তো গণতন্ত্রকে জবাই করা হয়েছে। একটি টার্ম চালু করা হয়েছিল, উন্নয়নের গণতন্ত্র। দুনিয়ার কোথাও এটা শুনিনি। গণতন্ত্র গণতন্ত্রই, উন্নয়ন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটা কোনো দয়া নয়।

নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই হওয়া উচিত। নির্বাচন যত দ্রুত হবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। তিনি বলেন, সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার। আমরা বিশ্বাস করি, অন্তর্বর্তী সরকার একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। এই সরকারের প্রতি আমাদের আস্থা আছে, জনগণের আস্থা আছে। তবে অবশ্যই এটা (নির্বাচন) সীমিত সময়ের মধ্যে, একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। ফখরুল বলেন, আমি নির্বাচনের ওপর জোর দিতে চাই। যেসব সংস্কার প্রয়োজন, তার জন্য নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের সংস্কার কীভাবে আসবে? একটি নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে এসব সংস্কার আসবে। এর বিকল্প কিছু নেই। তবে তিনি এও বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপিতে কোনো অস্থিরতা নেই। যত দ্রুত সম্ভব দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে তার দল মনে করে।

নির্বাচন প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমার বিবেচনায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য কোনোভাবেই ছয় মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। আমি মনে করি সেনাপ্রধান নির্বাচনের জন্য ১৮ মাস বা দেড় বছর সময়ের কথা বলেননি। তিনি নির্বাচন ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য ওই সময়ের কথা বলেছেন।

জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, সেনাপ্রধান নির্বাচনের জন্য যে ১৮ মাস সময়ের কথা বলেছেন সেটা নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তিনি তার অবস্থান থেকে বলেছেন। কিন্তু আমরা বলছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দিতে। তবে আমরা কোনো টাইম ফ্রেম বেঁধে দিচ্ছি না। তবে যত দ্রুত সম্ভব আমরা নির্বাচন চাই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, সেনাপ্রধান নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলেছেন। সেই সংস্কার ও নির্বাচনের জন্য তিনি ১৮ মাস সময়ের কথা বলেছেন। তিনি আসলে নির্বাচন নিয়েই ভাবছেন। কিন্তু রাষ্ট্র সংস্কারের যে কথা হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। আর সেই সংস্কারের জন্য ১৮ মাস পর্যাপ্ত সময় কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, নির্বাচনের বিকল্প নেই। অতিদ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, আমি মনে করি যে, এই সরকারের ন্যূনতম ২ বছর থাকা দরকার। এখন যদি এক বছর ছয় মাসের মধ্যে একটা নির্বাচন হয়, তাহলে আপনাদের কি মনে হয়, বিদ্যমান ব্যবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হবে? এখন যারা ক্ষমতায় আসার মতো সম্ভাব্য দল রয়েছে, আমরা দেখেছি অতীতেও এ দলগুলো ক্ষমতায় ছিল। তাদের কর্মকা- ও চরিত্র দেখেছি। রাতারাতি তো এ চরিত্রের বদল হবে না। তিনি বলেন, দুই বছরের জন্য একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রয়োজন, যারা রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন এনে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবে।

জানা গেছে, প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো অল্প সময়ের মধ্যে সেরে অল্প সময়ের মধ্যেই নির্বাচন চায় বিএনপি। সংস্কারের নামে লম্বা সময় দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে তাদের। বিএনপির নীতিনির্ধারণী একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন মনোভাবের কথা জানা গেছে। নেতারা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে বেশি সময় লাগার কথা নয়। তবে কিছুটা জটিলতা এবং সময়ের বিষয় আছে সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে। বিএনপি দুই বছর আগে দেওয়া তাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব এবং এ লক্ষ্যে জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টি সামনে এনে সক্রিয় হওয়ার পরিকল্পনাও করছে। এই প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে বিএনপি ইতিমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে, বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে পৃথক মতবিনিময়ও করেছে। বিএনপি বলছে, তারা ভোটে নির্বাচিত হলে আন্দোলনকারী দলগুলোকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার করে সংস্কারগুলো সম্পন্ন করবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, আমরা বলে আসছি প্রয়োজনীয় সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে। কারণ, যেনতেন কায়দায় নির্বাচন হলে তা ভালো ফল বয়ে আনবে না। এজন্য সংস্কারে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, যতটুকু সম্ভব দ্রুত করলে জনগণের মধ্যে কোনো সংশয় থাকে না, কোনো বিতর্ক আসে না।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসহ অনেক গণতান্ত্রিক সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই কাজগুলো করার সঙ্গে নির্বাচন করাটা জড়িত। যেসব জরুরি পরিবর্তন বা সংস্কারগুলো আছে, সরকার সেগুলোকে অগ্রাধিকারের মধ্যে রেখে এ ব্যাপারে কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আলোচনা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের যে নতুন বন্দোবস্ত, সংস্কার ইত্যাদি কাজগুলো সুনির্দিষ্ট করা দরকার। সে কাজ বাস্তবায়নের সময়সীমা কতটুকু, সেটি নির্ধারণ করা দরকার।

https://www.dailysangram.com/post/568119