২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার, ২:১৮

পাহাড় অশান্তের অপচেষ্টা

হঠাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করে তোলা হয়েছে। দেশের মানুষ পাহাড়ে এ অশান্তির নেপথ্যে পতিত শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষক ভারতকে দায়ী করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনদের মধ্যে এ নিয়ে চলছে তীব্র বিতর্ক। কেউ কেউ হঠাৎ পাহাড়ে অশান্তির নেপথ্যের রহস্য খুঁজতে শুরু করেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বিগত চার দশক ধরে বিপুল সংখ্যা বাংলাদেশি (সমতলের মানুষ) পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে বসবাস করছে। পাবর্ত্য শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং শান্তিশৃংখলা বজায় রয়েছে। এমনকি শেখ হাসিনার শাসনামলের ১৫ বছর পাহাড়ে কোনো শান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে দেখা যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এখন পাহাড়ে অশান্তির চেষ্টা? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানা গেছে, ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠী ছাত্রদের একটি গ্রুপ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখেছেন। এই ঔদ্ধত্যের নেপথ্যে কোন ষড়যন্ত্র চলছে? পাহাড়ের ওই ছাত্র সংগঠন নিজেদের দাবি-দাওয়া জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে চিঠি দিতে পারতেন। তাহলে কি বাংলাদেশ নিয়ে গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাহাড়ে এই অশান্তি! ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘের অধিবেশন। অধিবেশনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস। সেখানে কি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইস্যু করতে চায় পলাতক হাসিনার রাজনৈতিক মুরুব্বী হিন্দুত্ববাদী ভারত? এ সন্দেহের যথেষ্ট কারণও রয়েছে। ড. ইউনূস জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে সাইডলাইনে সার্ক সদস্যভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। কূটনৈতিকভাবে এ প্রস্তাব দেয়া হলে ভারত তা গ্রহণ করেনি। তবে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জাতিসংঘের অধিবেশনে সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বৈঠক হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হবে। তাহলে কি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশৃংখলা সৃষ্টির অপচেষ্টার নেপথ্যে দিল্লির ইন্ধন কাজ করছে?

তিনটি পাতানো জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এনে ভারত কার্যত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশভে তাদের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, হাসিনা রেজিমে প্রশাসন যন্ত্রে ভারতীয়দের মতামতকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হতো। সে কারণে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। অতঃপর ভারত তাদের নাচের পুতুল শেখ হাসিনাকে ফের বাংলাদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একের পর এক প্রতিবিপ্লবের ন্যায় অপকাণ্ড করছে। সামরিক ক্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যু, জুডিশিয়াল ক্যু, ১৫ আগস্ট ঢাকা দখল, আনছার বাহিনীর সচিবালয় ঘেরাও, প্রশাসনের কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে একের পর এক আন্দোলন করানো হয়। সবশেষে গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করতে শ্রমিকদের আন্দোলনে নামিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা হয়। ভারতের এসব অপচেষ্টার কোনোটিই সফল হয়নি। প্রতিটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। অতঃপর চানক্যনীতির দেশটি পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে।

মূলত জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের সাথে সাথে বাংলাদেশে ভারতের দাদাগিরিরও অবসান ঘটে। হাসিনার অবৈধ ক্ষমতার বিনিময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও সমুদ্রসীমায় অর্থনৈতিক, কৌশলগত, নিরাপত্তা প্রভৃতি সেক্টরে বাংলাদেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ববিরোধী যেসব চুক্তি সাধন ও নেটওয়ার্ক স্থাপনে সক্ষম হয় তার সব কিছুই চরম ঝুঁকির মুখে পড়ে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে পার্শ¦বর্তী পশ্চিমবঙ্গ, সেভেন সিস্টার্স ও রাখাইন অস্থিতিশীল হবে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সেভেন সিস্টার্সের নিরাপত্তা নিয়ে অতি উদ্বিগ্ন ভারতের মুখের ওপর ‘উইপোকা’ ভাবা বাংলাদেশের দিক থেকে এমন জবাব তাদের পছন্দ হবার কোনো কারণ ছিলো না। ফলে এর পাল্টা একটি জবাব যে ভারতের দিক থেকে আসবে সেটা অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন। ফলে ফ্যাসিস্ট ও তার পৃষ্ঠপোষকদের দিক থেকে প্রতিবিপ্লবী কামড় যে পাহাড়েই প্রথম দাঁত বসাতে চলেছে এমন আশঙ্কার কথা পাহাড় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখে আসছিলেন। বর্তমান অস্থিতিশীলতা এরই অংশবিশেষ, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

জুলাই বিল্পবের পর সারাদেশে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীরা ধরা পড়লেও পাহাড়ের আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাকর্মীদের কেউই ধরা পড়েনি। তাছাড়া সমতলের পলাতক নেতাকর্মীরা পাহাড়ি দূর্গমতার সুযোগ নিয়ে সেখানে পালিয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে। দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে পুলিশের যে বিপুল লুণ্ঠিত অস্ত্র এখনো জমা পড়েনি সেগুলো লুকানো ও বিক্রির জন্য পাহাড়ের থেকে উত্তম স্থান বাংলাদেশে নেই। এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীরা পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এহেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। এছাড়াও আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তাদের পাহাড়ি ভোট টানার কৌশল হিসেবে উপজাতীয় সংগঠনগুলো জনপ্রিয় ইস্যুগুলো কাজে লাগিয়ে পাহাড়িদের মধ্যে জনপ্রিয়তা তৈরির চেষ্টা করে থাকতে পারে।

ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের ইন্ধনে পাহাড়িরা তাদের ডিসপিউটেড (বিতর্কিত) দাবিগুলো বাস্তবায়নের সঠিক সময় হিসেবে বর্তমান শাসনামলকে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লব ঘটানোর জন্য পরাজিত একটি বিদেশি শক্তি যখন বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে, ঠিক তখন পাহাড়ে এ ধরনের পরিস্থিতি তাদেরকে অনুকূল পরিবেশ এনে দিয়েছে। পাহাড়িদের এ ষড়যন্ত্রের সাথে পতিত ফ্যাসিবাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকরা জড়িত বলে ব্যাপকভাবে সন্দেহের কারণ রয়েছে। কেননা পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে এই শক্তির পুরনো সখ্য রয়েছে। তারা শুরু থেকেই চেষ্টা করছিল পাহাড়ে যেকোনোভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে তাদের ডিসপিউটেড দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে নিতে। এতে সহযোগী হয়ে এসেছে পতিত ফ্যাসিবাদের এদেশীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা। তারা পাহাড়ি ও বাঙালি ভাগে ভাগ হয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে আদিবাসী স্বীকৃতি, ১৯০০ সালের শাসন বিধির সুবিধাজনক অংশ বাস্তবায়নসহ উল্লেখিত দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে নিতে চায়। যাতে এ অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। এটাই বর্তমান অস্থিতিশীলতার অন্যতম অন্তর্নিহিত কারণ।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ অস্থিরতা শুরুর সাথে সাথে ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার শুরু হয়ে যায়। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পুরাতন সংঘাত ও মন্দির ভাংচুরের ছবি পার্বত্য চট্টগ্রামের বলে চালিয়ে দেয়া হয়। হতাহতের বিপুল মনগড়া ও অবাস্তব সংখ্যা প্রচার করা হয়।

এদিকে ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী সান্তনা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ দাবি করে একটি পত্র দিয়েছেন। ত্রিপুরায় বাংলাদেশ দুতাবাসের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন স্থানীয় উপজাতীয় ছাত্ররা। এছাড়াও ভারতে বসবাসকারী চাকমা, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সাবেক মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ব্যাপকভাবে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দমোদর মোদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ জানানোর আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর না দেখা করা এবং বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক শিথিল করার আহ্বান জানানো হয় এসব পত্র ও স্মারকলিপিতে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের উপদেষ্টা মিনহাজ মুর্শিদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় ও এর বিভিন্ন অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের বেনিফিশিয়ারি রয়ে গেছে। তাদের অপসারণ না করা হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতীয়দের মাথা খারপ হয়ে গেছে। তারা কোনোভাবেই এটি মেনে নিতে পারছে না। তাই নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হাবিব আজম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর সারাদেশে তাদের সহযোগীদের আটক করা হলেও পাহাড়ে তার কিছুই দেখা যায়নি। বিগত সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও সুবিধাভোগী লুটেরাদের আটক না করা হলে তারা পাহাড়ি-বাঙালি হিসেবে ফিরে এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত করবে বারবার।

https://dailyinqilab.com/national/article/688218