২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার, ১:৪০

গ্রিন ফ্যাক্টরিতে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা

দেশ হারাচ্ছে কাঙ্খিত বৈদেশিক মুদ্রা

বিদেশী ক্রেতাদের শর্ত পূরণ করতে পোশাক কারখানার পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য শত শত কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করছেন উদ্যোক্তারা। এতে দেশে পরিববেশবান্ধব দুই শতাধিক কারখানা (গ্রিন ফ্যাক্টরি) গড়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু অসাধু মালিকের অসম প্রতিযোগিতায় এর সুফল ঘরে নিতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। তারা এক দিকে পোশাকের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অপর দিকে দেশ হারাচ্ছে কাক্সিক্ষত বৈদেশিক মুদ্রা। এতে সামগ্রিক রফতানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসম প্রতিযোগিতার কারণে দেশে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যা বড়লেও বাড়ছে না রফতানিকারক পোশাকের দাম। পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরি করতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন শত কোটি টাকা। তবে আন্তর্জাতিক বায়ার বা ক্রেতা দিচ্ছে না উচ্চমূল্য। এতে বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেও সুফল তুলতে পারছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পোশাক খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডের কাছ থেকে প্রিমিয়াম বা উচ্চমূল্যে পোশাক রফতানিকারকদের জন্য অধরা থেকে যাচ্ছে। যদিও বেশি দামে পোশাক রফতানির জন্য সবুজ কারখানা স্থাপন এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করার জন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, সবুজ কারখানাগুলো বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারে অপচয় রোধ করে থাকে। একই সাথে অভ্যন্তরীণ পরিবেশের গুণমান, কাঁচা মাল নির্বাচন এবং পরিবেশগত বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

একটি সবুজ কারখানায় বিনা বাধায় বাতাস চলাচল করতে পারে। দিনের আলো ব্যবহার, কম দূষণ এবং ক্ষতিকারক রাসায়নিক রঙ এবং ফিনিশিং-এর ক্ষেত্রে রয়েছে স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ।

গতকাল দুটি তৈরী পোশাক ও একটি সুতা তৈরির কারখানা পরিবেশবান্ধব সনদ পেয়েছে। কারখানাগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জের অনন্ত হুয়াজিং লিমিটেড, গাজীপুরের সেপাল গার্মেন্টস লিমিটেড ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ইউনিটেক্স স্পিনিং লিমিটেড (দ্বিতীয় ইউনিট)। এতে করে দেশে পরিবেশবান্ধব তৈরী পোশাক ও বস্ত্র কারখানার সংখ্যা বেড়ে ২২৯টিতে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানা তিনটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) থেকে পরিবেশবান্ধব সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের অনন্ত হুয়াজিং ৬৩ নম্বর নিয়ে গোল্ড সনদ ও গাজীপুরের সেপাল গার্মেন্টস ৮৫ নম্বর নিয়ে লিড প্লাটিনাম সনদ অর্জন করেছে। এ ছাড়া সীতাকুণ্ডের ইউনিটেক্স স্পিনিং (দ্বিতীয় ইউনিট) ৮৩ নম্বর নিয়ে প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে। তৈরী পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ গতকাল এ তথ্য জানিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০০ পরিবেশবান্ধব কারখানার ৬১টি বাংলাদেশে অবস্থিত বলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিজিএমইএর তথ্যে দেখা যায় তৈরী পোশাক ও বস্ত্র খাতে বর্তমানে লিড সনদ পাওয়া পরিবেশবান্ধব কারখানা বেড়ে হয়েছে ২২৯টি। এর মধ্যে ৯১টিই লিড প্লাটিনাম সনদধারী। এ ছাড়া ১২৪টি গোল্ড, ১০টি সিলভার ও ৪টি কারখানা সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। এর আগে সর্বশেষ গত ১৬ আগস্ট দুটি রফতানিমুখী তৈরী পোশাক কারখানা পরিবেশবান্ধব সনদ পায়। কারখানাগুলো হলো আশুলিয়ার সাদাতিয়া সোয়েটার্স ও গাজীপুরের এক্সিকিউটিভ গ্রিনটেক্স লিমিটেড। এর মধ্যে সাদাতিয়া সোয়েটার্স ৯১ নম্বর নিয়ে লিড প্লাটিনাম সনদ ও এক্সিকিউটিভ গ্রিনটেক্স ৬৯ নম্বর নিয়ে লিড গোল্ড সনদ অর্জন করে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০ পরিবেশবান্ধব কারখানার ৯টিই বাংলাদেশে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি লাভ করেছে গাজীপুরের কোনাবাড়ীর এসএম সোর্সিং। দেশের অন্য শীর্ষস্থানীয় পরিবেশবান্ধব কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহের গ্রিন টেক্সটাইল, গাজীপুরের নিট এশিয়া ও ইন্টিগ্রা ড্রেসেস, নারায়ণগঞ্জের রেমি হোল্ডিংস ও ফতুল্লা অ্যাপারেলস, গাজীপুরের লিডা টেক্সটাইল অ্যান্ড ডাইং ও লিজ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ এবং মানিকগঞ্জের তারাসিমা অ্যাপারেলস।

দেশের প্রথম বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়া সবুজ কারখানা প্লামি ফ্যাশনের উদ্যোক্তা ও বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘সবুজ পোশাক কারখানাগুলি ক্রেতাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। বিদেশী বায়ার প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়মকানুন মেনে চলার ক্ষেত্রে কঠোর মনোভাব দেখিয়ে থাকে। তবে দামে বেশি দেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ কম’।

তিনি বলেন, সবুজ কারখানার তুলনায় সাধারণ কারখানাগুলো ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি বিদ্যুৎ এবং পানি ব্যবহার করে থাকে। সবুজ কারখানার কারণে প্লামি ফ্যাশন সবসময় ক্রেতাদের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকে। সুবিধা হলো আমরা অর্ডার বেশি পাই। তবে দামের ক্ষেত্রে অন্যদের মতোই।

তিনি বলেন অতিরিক্ত খরচ করে, কারখানাকে পরিবেশবান্ধব করে পরিবেশের অনেক লাভ হচ্ছে তা ঠিক, তবে ব্যবসায়ীদের কী লাভ। পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরিতে অতিরিক্ত খরচ যদি হয়ও সেই খরচটাকে ব্যবসায়ীরা দেখতে পারেন বিনিয়োগ হিসেবে। কারণ বর্তমানে পরিবেশবান্ধব কারখানায় পণ্য তৈরি হওয়া মানে বিশ্ববাজারে একধাপ এগিয়ে থাকা।

পোশাক খাতের ক্রেতারা অর্ডার করে এই গ্রিন ফ্যাক্টরি দেখে। তিনি যেই পণ্যটি কিনছেন সে পণ্য তৈরিতে পরিবেশের বা কর্মীর কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না এটা আন্তর্জাতিক ক্রেতারা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন। এগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বড় বিষয়।
এবিএ গ্রুপের গ্রুপ চেয়ারম্যান সাজ্জাদুর রহমান মৃধা নয়া দিগন্তকে বলেন, সবুজ কারখানগুলো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এগিয়ে থাকে। এসব কারখানাকে অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। তবে ক্রেতারা বেশি দাম দেয় না। কিন্তু ক্রেতারা যখন অর্ডার দিতে চায় তখন সবুজ কারখানাগুলো অগ্রাধিকার তালিকায় থাকে। তাদের কোম্পানির পাঁচটি লিড প্রত্যয়িত পোশাক কারখানা রয়েছে বলে তিনি জানান।

ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রেজাউল হাসানাত বলেন, পোশাক কারখানা সবুজ বা পরিবেশবান্ধব করার জন্য ক্রেতারা অতিরিক্ত কিছু দেন না। বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্ম পরিবেশ নিরাপদ করতে জোরদার করতে অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের সুপারিশ বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু তাও ক্রেতাদের অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের জন্য প্ররোচিত করে না। তিনি বলেন, তাদের কোম্পানির দুটি সবুজ পোশাক কারখানা রয়েছে।

অনন্ত গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শরীফ জহির বলেন, ক্রেতারা দাম নিয়ে আলোচনার সময় সবুজ উদ্যোগের বিষয়টিও সামনে আনেন না। তবে তারা চায় যে ডেনিম জিন্সের কাপড় ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত ৭৫ শতাংশ পানি পুনর্ব্যবহৃত করা হোক।
তিনি অবশ্য বলেছেন, ক্রেতারা নিয়মিত অর্ডার দেয়ার কারণে চার বছরের মধ্যে সবুজের কারখানা স্থাপনের জন্য বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসে।

ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) ফ্যাকাল্টি সদস্য স্থপতি নাজলি হুসেন বলেন, সবুজ কারখানার মালিকদের জন্য পরোক্ষ সুবিধা উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, সরকার সবুজ পোশাক কারখানার জন্য করপোরেট কর নির্ধারণ করেছে ১০ শতাংশ, যা সবুজ নয় এমন কারখানার জন্য ১২ শতাংশ। তা ছাড়া সবুজ পোশাক কারখানার মালিকরা সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

এ ছাড়া সবুজ কারখানাগুলো ৩০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ এবং পানি ব্যবহার করে, যার বাজারমূল্য বছরের শেষে বেশ উল্লেখযোগ্য হতে পারে। তিনি বলেন, একটি গ্রিন ফ্যাক্টরি বিল্ডিং তৈরি করতে মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ বেশি খরচ করতে হবে। সবুজ পোশাক কারখানার সংখ্যা বেশি হওয়ায় চীন ও ভিয়েতনাম থেকে প্রচুর কাজের অর্ডার বাংলাদেশে আসছে বলে তিনি জানান।

ইউএসজিবিসির পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের আঞ্চলিক বাজার উন্নয়নের প্রধান সান্তনু দত্ত গুপ্ত বলেন, পোশাক খাতের নেতারা এবং ইউএসজিবিসি সম্প্রতি বাংলাদেশের সবুজ উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে দামের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে ক্রেতারা দামের বিষয়টি নিয়ে ভাবছে বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি হিসেবে একটি সবুজ পোশাক কারখানা তৈরি করা হয়েছে। যদিও ক্রেতারা এর জন্য বাড়তি কিছু দেন না।
প্রাথমিকভাবে, গ্রিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গ্রহণের জন্য খরচ কিছুটা বেশি মনে হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে, দামের আলোচনায় প্রতিযোগিতামূলক অগ্রগতি অর্জন করায় সুবিধাগুলো খরচের বিষয়টি ছাড়িয়ে যায় বলে তিনি মনে করেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/19651759