দেশে মূলত তিনটি প্রতিষ্ঠান বাজার নিয়ন্ত্রণ, নিত্যপণ্যের মান যাচাই ও খাদ্য নিরাপদ রাখার কাজ করে। সারা বছর রুটিনমাফিক কাজ করলেও রোজায় আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান, বাজার মনিটরিং ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতারা বলছেন, বাজারে ব্যবসায়ীরা যেভাবে চান, সেভাবেই তাঁদের সহায়তা করা হয়।
তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা খুব একটা নেই। এতে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন ভেজালকারী ও নিয়ম না মানা ব্যবসায়ীরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। তবে ভেজালকারীরা রয়ে যাচ্ছেন পর্দার আড়ালে।
জেলা প্রশাসনসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন কারণে অভিযান পরিচালনা করে। এর মধ্যে কিছুটা কার্যকর ভূমিকা রাখে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তিন প্রতিষ্ঠানের বাজার তদারকি, মনিটরিং, খাদ্য স্থাপনা পরিদর্শন ও মোবাইল কোর্ট বসানোর ঘটনা পাঁচ হাজার ৪৬০টি। মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে আট হাজার ৪৩ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
জরিমানা করা হয়েছে ৯ কোটি ৩৯ লাখ তিন হাজার টাকা।
ভোক্তা অধিদপ্তর একই সময়ে প্রায় তিন হাজার ৬০০টি বাজার তদারকি করে। এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার ৬০০টি প্রতিষ্ঠানকে আইনানুগ শাস্তি দেওয়া হয়। জরিমানা আদায় করা হয় সাত কোটি সাত লাখ টাকা।
বিএসটিআই মোট ৪১৭টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে।
মামলা করা হয় ৪১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, জরিমানা আদায় করা হয় প্রায় দুই কোটি ১৪ লাখ টাকা। লাইসেন্স দেওয়া প্রতিষ্ঠানে তদারকি বা সার্ভেইল্যান্স করা হয় ৫০০টির বেশি প্রতিষ্ঠানে, আদালতে নিয়মিত মামলা করা হয় প্রায় ৩৫টি। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সিলগালা করা হয় চারটি কারখানা। ভেজাল ঠেকাতে এই প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে।
বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লাইসেন্স না নিয়ে ভেজাল ও নকল পণ্য উৎপাদনের কারণে এসব মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে। একই সঙ্গে আমদানি পণ্যের ছাড়পত্র না নিয়ে বিক্রি করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এতে ওই সব বিদেশি পণ্য ভেজাল করে উৎপাদন করার আশঙ্কাও থেকে যায়।
অন্যদিকে একই সময়ে বিএফএসএ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সারা দেশে বিভিন্ন বাজার-রেস্তোরাঁ মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। গত রোজার মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকাকে সাত জোনে ভাগ করে ইফতার বাজার পরিদর্শন করা হয়। এতে ইফতার পণ্যের প্রদর্শন-পরিবেশন, ভাজাপোড়া তৈরিতে পোড়া তেলের ব্যবহার, স্পর্শকের নিরাপত্তা, রান্নাঘরের পরিবেশ, ফ্রিজে খাবার সংরক্ষণ, ওয়াশরুম, পরিবেশন এলাকা ও খাদ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মনিটর করে তারা। খাদ্য ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদ খাবার প্রস্তুত করতে কর্মীদের পরামর্শ ও লিফলেট দেওয়া হয়। রোজার পর বেশির ভাগ হোটেল, রেস্তোরাঁ তদারকি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে প্রায় এক হাজার ৪০৮টি খাদ্য স্থাপনা ও বাজার পরিদর্শন করে। একই সময়ে বিএফএসএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভেজালবিরোধী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন ৩৫টি। মামলার সংখ্যা ২৫, জরিমানা আদায় করা হয় ১৮ লাখ তিন হাজার টাকা।
এমন অবস্থায় ভোক্তাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের এমপিদের মধ্যে ২০০ জনই ছিলেন ব্যবসায়ী। মন্ত্রীদের মধ্যেও প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী ছিলেন। ফলে যেসব প্রতিষ্ঠান ভেজাল বা অনিয়ম করে, তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এমপি ও মন্ত্রীরা তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছেন। ভোক্তাদের জন্য কিছুই করা হতো না।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এই সংগঠনের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বলতে গেলে বাজারে তেমন অভিযানই করেনি। যা করেছে তা পর্যাপ্ত নয়। বাজার তদারকিতে যে ধরনের শক্তি প্রয়োগ দরকার, তা আগে দেখা যায়নি। আর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তো অভিযানে খুব একটা জরিমানাই করে না। গত রোজায় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হয়েছিল, বাজারে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় গিয়ে যেন তদারকি না করে। একজন মন্ত্রী যখন মৌলভীবাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করলেন, ওখানে ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল বাজারে কাউকে পাঠানো যাবে না। তখন উনি বলেছিলেন, বাজারে কাউকে হয়রানি করতে দেব না। উনি কথা রেখেছেন। এবার জেলা প্রশাসন বাজারে ছবি তোলার জন্যও যায়নি। ভেজাল পণ্য রোধে এখানে ভোক্তাদের জন্য কিছুই নেই। আমরা হতাশ। এখন কিছু কিছু জায়গায় ভোক্তারা কৌশল অবলম্বন করছেন। যেগুলোর দাম বাড়ছে, সেগুলো বয়কট করছেন। বয়কট করলে একটা ইতিবাচক ফল আসবে।’
পণ্যের ভেজাল রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিএসটিআই। প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত ২৭৩টি পণ্যের মান সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু জনবল সংকট, প্রতিটি জেলায় অফিস না থাকায় জোরালো কার্যক্রম চালাতে পারছে না। এর পরও যথাযম্ভব নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে যাচ্ছে। এতে যেভাবে পণ্যে ভেজাল করা হয়, সেই তুলনায় অভিযান পর্যাপ্ত নয়।
পণ্যে ভেজাল রোধে সরকারের অন্যতম প্রধান সংস্থা বিএসটিআইয়ের সদ্য সাবেক মুখপাত্র ও উপপরিচালক (সিএম) মো. রিয়াজুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা ভেজাল করে তাদের ঠিকানা দিলে আমরা অভিযান চালাতাম। ঢাকায় প্রতিদিন অন্তত দুটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। জেলা শহরগুলোতেও আমরা অভিযান চালাই। আমাদের চেয়ে কোন অফিস বেশি অভিযান চালায়? তবে পর্যাপ্ত কোনো কিছুই হয় না। আমাদের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে সর্বোচ্চ যা করার তা করা হয়। আমরা ছুটির দিনেও কাজ করেছি।’
https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/09/01/1420831