৩১ আগস্ট ২০২৪, শনিবার, ১২:২৩

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় যেভাবে ভঙ্গুর ব্যাংক খাত

ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও দুর্বল হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক নীতি-সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রভাবশালী কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে। ব্যাংক খাত ভঙ্গুর হওয়ার পেছনে যার দায় কম নয়। বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ পুনঃতপশিল এবং পুনর্গঠনের সুযোগ, সুদহারের সীমা বেঁধে দেওয়া, বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণের হার কমানো, ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতো স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। নিজেদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানে যারা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সরকার পতনের পর তাদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে আটক হয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কয়েকজন নির্বাহীর সঙ্গে এ প্রতিবেদক গত কয়েক দিন কথা বলেছেন। তাদের বেশির ভাগই বলেছেন, সাবেক আমলা ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নরের দায়িত্ব পাওয়ার পর ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও ভঙ্গুর হয়েছে। সাবেক দুই গভর্নর অনিয়মের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম সীমিত করেন। আরেক দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে একের পর এক নীতি-সহায়তার নামে ঋণখেলাপিদের সুযোগ করে দেন। ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণে অন্যায্য প্রভাব খাটিয়েছেন। কোনো সুবিধা নেওয়ার সময় এলেই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতেন বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তারা দু’জন এখন আত্মগোপনে।

২০১৪ সালে দেশে একতরফা নির্বাচনের পর ব্যাংক খাতে একের পর এক ঋণ পুনঃতপশিল, পুনর্গঠন বা এক টাকাও শোধ না করে ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে ফজলে কবির গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর মধ্যস্থতায় কয়েকটি ব্যাংক দখল, হোটেলে বসে সিআরআর কমানোর সিদ্ধান্ত, আমানতে ৬ শতাংশ এবং ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা নির্ধারণ, নিয়ম ভেঙে ব্যাংকের সিএসআর তহবিলের বড় অংশই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেওয়া, আইন সংশোধন করে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগসহ নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে মেয়াদি ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণের সময় এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়। নানা সুবিধা নিয়ে ঋণ শোধ না করেও কাগজে-কলমে খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ পেয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী। এর পরও গত মার্চে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ঠেকেছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃত হিসাবে এই খেলাপি ঋণ প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দখল হয়ে গিয়েছিল। স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঢুকে পড়েছিল। সিআরআর কত হবে, সুদহার কী হবে, টাকা ছাপাবে কী ছাপাবে না, কোন ব্যাংকে কোন ধরনের অনুমোদন দেওয়া হবে–এ ধরনের সবই করা হয়েছে বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে। এটি এমন নয়, সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে নীতি করা হয়েছে। নীতি দেখলেই বোঝা যেত, কাদের সুবিধা দিতে করা হয়েছে।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুটপাটকারীদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সাবেক দুই গভর্নর নিজেরা বুঝতে পেরেছেন, তারা যে কাজ করেছেন, তাতে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে গেছে। ব্যাংক খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। যে কারণে গা-ঢাকা দিয়েছেন। তারা খারাপ কাজ ঢাকার জন্য অনেক ধরনের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করেন। এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কলুষিত হয়ে পড়েছে। জাহিদ হোসেনের মতে, কোনো একটি নীতি করার পর তা ব্যর্থ করতে পারে এবং অর্থনীতির জন্য ভালো না খারাপ তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ নীতি করা হয়েছে কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য। যখনই যে সুবিধা চেয়েছে, তাকে সুবিধা দেওয়ার জন্য সার্কুলার করা হয়েছে। রাতারাতি নীতি পরিবর্তন হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি নীতির সঙ্গে আরেক নীতির কোনো সামঞ্জস্য ছিল না।

প্রভাবশালীদের অনেকেই আত্মগোপনে, ছেড়েছেন পদ
আওয়ামী লীগের শাসন আমলে রাজনৈতিক প্রভাবে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। এরই মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংক। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকও এ প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এসব ব্যাংক চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে।
গত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে প্রভাবশালীদের কেউ কেউ নিজ থেকে পদ ছেড়ে দিয়েছেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ সরে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব দিয়েছেন মোহাম্মদ আব্দুল আজিজকে। নানা নাটকীয়তার পর ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদ থেকে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের পরিবারমুক্ত করে গত ২৭ আগস্ট পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে কৌশলে জাবেদ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে নানা নাটকীয়তা হয়। প্রথমে ব্যাংকটি থেকে জাবেদের স্ত্রী রুখমিলা জামানকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁর বোন রোখসানা জামান চৌধুরীকে। এর পর গত ২৭ আগস্ট তড়িঘড়ি করে আবার বোনকে সরিয়ে সাবেক সচিব স্বতন্ত্র পরিচালক ড. অপরূপ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করা হয়। ব্যাংকটির এমডি আরিফ কাদরীসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কয়েকদিন ধরে ব্যাংকে আসছেন না। ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারকে এক্সিম ব্যাংক থেকে সরিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে।

নতুন প্রজন্মের ব্যাংকের মধ্যে বিভিন্ন কারণে সমালোচিত হয়েছে পদ্মা, এনআরবি কমার্শিয়াল ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল পদত্যাগ করে নিজের পছন্দের কাউকে বসানোর চেষ্টা করছেন। এ জন্য গত শনিবার গোপনে একটি পর্ষদ সভা ডাকলেও তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সফল হননি। সাউথ বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন গত ৩১ জুলাই পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পালিয়েছেন। এ ছাড়া প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি ডা. এইচবিএম ইকবাল, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি মোরশেদ আলম, যমুনা ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ছেলে মো. সাইদুল ইসলাম, মেঘনা ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি এইচএন আশিকুর রহমানসহ অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এতে করে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য যত সুবিধা

২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর ঋণ পুনঃতপশিলের বিশেষ সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সুবিধা নিয়ে নিয়মিত হয় ১৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এর পরের বছরের জানুয়ারিতে আবার ব্যাংক খাতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে– এরকম ব্যবসায়ীদের মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিয়ে ১২ বছরের জন্য পুনর্গঠনের সুবিধা দেওয়া হয়। এ সুবিধা নিয়ে ১১টি শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন করা হয়।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনা সামনে আসার পর পদত্যাগে বাধ্য হন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। গভর্নরের দায়িত্ব পান সাবেক সচিব ফজলে কবির। ফজলে কবিরের সময়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে বিভিন্ন নীতির পরিবর্তন আসতে থাকে। সবকিছু ছাপিয়ে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) আয়োজনে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বসে ব্যাংকের সিআরআর কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং গভর্নর ফজলে কবিরের উপস্থিতিতে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠক শেষে কোনো রাখঢাক না রেখে বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, তারল্য সংকটের কারণে সিআরআর সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংক মালিকদের দাবির মুখে আইন সংশোধন করে ছয় বছরের পরিবর্তে টানা ১৫ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দেয় সরকার। আবার এক পরিবার থেকে এক ব্যাংকে চারজন পরিচালক থাকার বিধান যুক্ত করা হয়। আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘোষণা দেন, খেলাপি ঋণ ১ টাকাও বাড়বে না। এ ঘোষণার পর ২০১৯ সালে আবারও মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতপশিলের সুযোগ দেওয়া হয়। তখন ৫২ হাজার কোটি টাকা পুনঃতপশিল হয়।
২০২২ সালের জুলাইয়ে গভর্নরের দায়িত্ব পান সাবেক সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি দায়িত্ব নিয়েই ডাউনপেমেন্ট জমার শর্ত শিথিল করে চারবারে একটি ঋণ ২৯ বছরের জন্য পুনঃতপশিলের সুযোগ দেন। বিভিন্ন ব্যাংকের খারাপ অবস্থা সামনে এনে ১০টি ব্যাংক আলাদাভাবে তদারকির কথা জানান। এসব ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগ দিয়েও কোনো উন্নতি হয়নি। সর্বশেষ কয়েকটি ব্যাংক জোর করে একীভূতকরণ শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে অনৈতিক বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলে শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগও হোঁচট খায়। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে যান এস আলম। ওই দিন তড়িঘড়ি করে ব্যাংকের এমডিদের ডেকে ডলার কেনার দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে এস আলম গ্রুপকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সব ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের চলতি হিসাবে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রেখে লেনদেনের সুযোগ দেন তিনি। অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য জেনেও তিনি ব্যবস্থা নেননি। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে নতুন সরকারে গভর্নরের দায়িত্ব পেয়েছেন ড. আহসান এইচ মনসুর।

https://samakal.com/somridhhi/article/253587