৩১ আগস্ট ২০২৪, শনিবার, ১২:২২

অপরাধীর হাতে পুলিশের অস্ত্র দেশ জুড়ে নিরাপত্তা শঙ্কা

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ৫ই আগস্ট দুর্বৃত্তরা থানায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। লুট করে নিয়ে যায় থানার অস্ত্র, গুলি, টিয়ারশেল, নথিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু। পুড়িয়ে দেয়া হয় স্থাপনাসহ বিভিন্ন মামলার আলামত। এ ছাড়া কিছু জায়গায় পুলিশ সদস্যদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব, পুলিশের নতুন আইজি নিয়োগের পর নানা উদ্যোগ নিয়ে থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হচ্ছে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র এখনো পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। যারা সরকারি অস্ত্র লুট করে নিয়ে গেছে তাদের হাতে এখনো সেগুলো রয়েছে। এতে করে দেশ জুড়ে নিরাপত্তা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারি এসব অস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে থাকার সম্ভাবনা একেবারে নাই। পরিকল্পিতভাবে বিক্ষুব্ধ জনতার ভিড়ে ঢুকে অপরাধীরাই এসব অস্ত্র লুট করেছে।

সরকারি এসব অস্ত্র ব্যবহার করে অপরাধীরা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই উদ্যোগ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।

পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে চায়না রাইফেল, এসএমজি, শটগান, এলএমজি, পিস্তল, গ্যাসগান রয়েছে। এর বাইরে গুলি, টিয়ারশেলও রয়েছে। লুট হওয়ার পর ছাত্র-জনতা, সেনাবাহিনী ও পুলিশের উদ্যোগে বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ২৯শে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৩ হাজার ৩০৪টি উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া ২ লাখ ৫০ হাজার ৯৭৪ রাউন্ড গুলি, ২১ হাজার ৩৯৫টি টিয়ারশেল এবং ১৯৩৯টি সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার হয়েছে। এদিকে এখনো সেনাবাহিনীর সদস্যরা থানা ও পুলিশের স্থাপনাগুলোতে নিরাপত্তা দিচ্ছে। একদিকে থানার নিরাপত্তা অন্যদিকে পুলিশ নিজে থেকে অভিযান চালাতেও ভয় পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টসূত্র বলছে, এলাকাভিত্তিক অপরাধীরা থানা থেকে অস্ত্র লুট করেছে। এসব অস্ত্র ছিনতাইকারী, মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের কাছে চলে গেছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ছোটখাটো অপরাধও কেউ কেউ করছে। পুরাতন ও নতুন বিভিন্ন মামলার আসামিদের হাতেও সরকারি অস্ত্র থাকতে পারে। তাই আসামি ধরতে গেলেও একটা ঝুঁকি থাকবে। কারণ আসামিরা পুলিশের ওপর হামলা করতে পারে।

এদিকে লুট হওয়া অস্ত্র কারও কাছে থাকলে সেটি আগামী ৩রা সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিকটস্থ থানায় জমা দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এক বিজ্ঞপ্তিতে সদর দপ্তর জানিয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন থানা, ইউনিট ও ডিউটিস্থল থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের লুট হওয়া কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ ইতিমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। লুণ্ঠিত অবশিষ্ট অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কোনো ব্যক্তির কাছে এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ রক্ষিত থাকলে ৩রা সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিকটস্থ থানায় জমা দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, ৫ ও ৬ই আগস্ট ডিএমপির বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে ১ হাজার ৮৯৮টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩৪৮টি চায়না রাইফেল, শটগান ৭০৩টি, ৩০টি এসএমজি (টি-৫৬ চায়না মডেল), ১৩টি এলএমজি, ৮৯টি পিস্তল (টি-৫৪ চায়না), ৫৬০টি পিস্তল, ১৫২টি গ্যাসগান ও ৩টি টিয়ারগ্যাস লাঞ্চার। এরমধ্যে ২৪শে আগস্ট পর্যন্ত ৪৫৩টি উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৪৪৫ অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি। বাকি অস্ত্রগুলো উদ্ধারে প্রতিদিনই অভিযান চালানো হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধারে গঠিত কমিটি প্রতিদিনই উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, থানা ও ফাঁড়ি থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে সেগুলো উদ্ধারের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কিছু অস্ত্র উদ্ধার হলেও এখনো অনেক অস্ত্র অপরাধীর হাতে রয়েছে। যেসব অস্ত্র নিয়েছে সেগুলো বৈধ অস্ত্র। সেগুলো যখন কোনো অনৈতিক কাজে বা ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে তখন ভয়টা সকল মানুষের। কারণ কার হাতে অস্ত্র আছে সেটি কিছুটা অনুমান করা যাচ্ছে। যারা বৈশিষ্টগত দিক দিয়ে দখলদারিত্ব মনোভাব, সমাজে তার নিজের কোনো উদ্দেশ্য পূরণ করতে চায়, কাউকে তার ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রশমিত করা বা কোনো চক্রের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চায়। এসমস্ত কাজেই বৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে। তাদের প্রয়োজনে অস্ত্রের ব্যবহার যখন করবে তার প্রভাবটা সমাজের ওপর পড়বে। শৃঙ্খলা, নাগরিক নিরাপত্তা বা নির্বিঘ্নে চলাফেরার অধিকারে প্রভাব পড়বে। এতে করে একটা আশঙ্কার জায়গা তৈরি হয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এ এন এম মুনীরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, এ ধরনের অস্ত্র যখন অপরাধীর হাতে চলে যায় তখন সমাজ ও রাষ্ট্রের ঝুঁকি থাকে। তাই যত শিগগির সম্ভব অভিযান চালিয়ে হোক আর অন্য কোনোভাবে হোক সেগুলো উদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি বলেন, প্রথমে সময় বেঁধে দিতে হবে। সেটিতে যদি উদ্ধার না হয় তবে একটা শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করে সেগুলো যারা নিজের কাছে রেখেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কাজটা বেশ শক্তভাবে করতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=125311