কেউ বলছেন আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও, কেউ বলছেন আমার স্বামীকে একটিবার দেখতে চাই, কেউ বলছেন ঘুমের মধ্যে আমার ভাই এসে বলে আমাকে এখনো বের করলি না তো তোরা। তোরা কি করছিস, কোথায় যাচ্ছিস? আমি এখানে আছি, আমাকে বের কর। আবার কেউ বলছেন আমার ছেলেকে না দেখে মরেও শান্তি পাবো না। গতকাল রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিবাদে এক মানববন্ধনে এভাবেই কান্নাঝরা কণ্ঠে অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিলেন স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা।
মানববন্ধনে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই আমাদের দিকে একটু তাকান, আমরা আর পারছি না। আমরা তো মানুষ, আমাদের ভেতর অনুভূতি আবেগ ও ভালোবাসা আছে। আমরা চাই অবিলম্বে আয়নাঘরগুলোর সন্ধান দিন। সরকারের যেসব উপদেষ্টা রয়েছেন তারা যেন আমাদের খবর দেন, দেশে আর কোনো আয়নাঘর নেই। জানি না তাদের ভাগ্যে কোন নির্মম পরিণতি হয়েছে কি না। যারা বেঁচে আছেন অবিলম্বে আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে দেয়া হোক এবং গুম হওয়ার সবাইকে সেটি হোক জীবিত কিংবা মৃত।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো দাবি জানিয়ে বলেন, যারা গুমের শিকার হয়েছেন অবিলম্বে তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। এ ঘটনার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও তোলেন তারা। সেই সাথে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়ার আহ্বান জানায় সংগঠনটি। এ ছাড়াও আয়নাঘর থেকে যারা বেরিয়েছেন তারা প্রকাশ করেছেন দুর্বিষহ নির্যাতনের কথা। গুমের ঘটনা যাতে আর কখনো না ঘটে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
মানববন্ধনে গুম হওয়া মাজহারুল ইসলাম রাসেলের ছোট বোন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান লাবনী কান্নারত অবস্থায় নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, ২০১৩ সালে ৪ ডিসেম্বর ভাইকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লক থেকে র্যাবের গাড়ি উঠিয়ে নিয়ে যায়। সেই থেকে আর খোঁজ নেই। এখনো পরিবারের সদস্যরা রাসেলের ফিরে আসার অপেক্ষায়। একে একে ১১ বছর কাটতে চললেও রাসেল আর ফিরে আসে না। তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে র্যাবের সদর দফতর, র্যাব প্রধান, সিইওসহ সবার সাথে দেখা করি। আমার বাবা-মা-বড় ভাই নিয়মিত যেতে থাকেন। যদিও তারা (র্যাব) অস্বীকার করেনি। শুধু বলত চুপ করে থাকেন ও আছে। নির্বাচনটা যাক রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক, দেখা যাক তারপরে কি করা যায়। তার পরও আর কোনো সন্ধান পাইনি আমার ভাইয়ের। বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীন হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যিনি প্রধান উপদেষ্টা রয়েছেন, তার কাছে অনুরোধ করব আমার মায়ের মতো যেসব মা না ঘুমিয়ে রাত পার করছেন প্লিজ আমাদের দিকে তাকান। আমি বিশ্বাস করি, আমার ভাইসহ অনেকেই হয়ত জীবিত রয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন অবিলম্বে আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে দেয়া হোক।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে আনিশা ইসলাম জানান, পাঁচ বছর ধরে বাবার ছবি হাতে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন তিনি। সে ও তার ছোট ভাই এখনো প্রতি রাত অপেক্ষা করেন, বাবা কখন ফিরবে। মানববন্ধনে আনিশা বলেন, আমার বাবা জীবিত নাকি মৃত সেটা অন্তত আমি জানতে চাই। যারা মারা যায়, তাদের কবর জিয়ারত করা যায়, কিন্তু আমরা এমনই হতভাগা, আমরা জানি না আমাদের বাবা জীবিত নাকি মৃত। আমি আমার স্কুলের কোনো কাজে বাবার সিগনেচার নিতে পারি না। নামের শুরুতে জীবিত না মৃত কিছুই লিখতে পারি না। আনিশার বাবা ইসমাইল হোসেন বাতেন ২০১৯ সালের ১৯ জুন শাহ আলী মাজারসংলগ্ন তার কাঠের দোকান থেকে নিখোঁজ হন।
গুম হওয়া ঝন্টু রহমানের হাসিনা বেগম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধানের কাছে বলতে চাই যেন আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। আমরা মায়েরা যেন সন্তানদের মুখগুলো দেখতে পারি, এতটুকুই আমার অনুরোধ। আমি আর কাঁদতে পারছি না, হার্টের রোগী হয়ে গেছি। ওর বাবা চলে গেছে, একটা মা তার সন্তানের গুমের বিবরণ দিতে পারে না। আমি সন্তানকে একটিবার দেখতে চাই। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, গোপালগঞ্জ-ফরিদপুরের কারাগার তল্লাশি করেন, আমার সন্দেহ হয়ত আমার বাবা ওখানে আছে।
গুম হওয়া থেকে ফেরত এসেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক সংগঠন ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা, সঙ্গীতশিল্পী রানা, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। ফেরত এলেও তারা ভুলতে পারেন না সেইসব স্মৃতি। তাদের বর্ণনা উঠে আসে লোমহর্ষক বর্ণনা। আওয়ামী সরকারের তৈরি আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমা বলেন, আমাকে পাঁচ বছর তিন মাস গুম করে রাখা হয়েছিল। আলো-বাতাসহীন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এই কষ্টটা আমি জানি। দিনের পর দিন সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছে। এটা শুধু বেঁচে থাকা নয়, অনেকটা মৃত্যুর মতো। এটা বুঝি, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার কত কষ্টে দিন কাটায়। তিনি আরো বলেন, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার আমলে কোনো ডেমোক্র্যাসি ছিল না। মানবাধিকার ছিল না, মানুষের নিরাপত্তা ছিল না। এই হাসিনা গত ১৫ বছরে যে গুম-খুন করেছে, তার একটা সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার হতে হবে।