২৯ আগস্ট ২০২৪, বৃহস্পতিবার

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধে আওয়ামী প্রজ্ঞাপন বাতিল

স্টাফ রিপোর্টার : জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও এর সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে দেয়া বিগত আওয়ামী সরকারের সময় দেয়া প্রজ্ঞাপন বাতিল করেছে সরকার। গতকাল বুধবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে। সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছেন।

গতকাল দেয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘যেহেতু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাস ও সহিংসতায় সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নাই; এবং যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে জড়িত নহে’ তাই দলটির নিষিদ্ধ ঘোষণা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হলো।

এর আগে জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী এডভোকেট শিশির মনির বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তা প্রত্যাহার করেছে সরকার। আজই গেজেট প্রকাশ হবে। তিনি জানান, এখন নিবন্ধন ফিরে পেতে আইনি লড়াই শুরু করা হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন ভিন্ন দিকে নিতে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

এ দিকে বিশেষ সময়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে জামায়াতেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও এর সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারির পর গতকাল বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি।

আসিফ নজরুল বলেন, ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে জামায়াতেকে নিষিদ্ধ করে নাই কেন। যখন ছাত্র-জনতার বিপ্লব চলছিল তখন তা নির্মমভাবে সন্ত্রাসী চিহ্নিত করে এই আন্দোলনকে দমাতে চেয়েছিল। ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে অন্যায়ভাবে পরাজিত করার কৌশল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আসলে জামায়াতকে চাপে রেখে তাদের পক্ষে কাজ করাতে চেয়েছে’Ñ এমন মন্তব্য করে আসিফ নজরুল বলেন, সেটা গত ১৫ বছরে পারেনি। তাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় যেটা করল সেটা তাদের অপকৌশল।

আসিফ নজরুল বলেন, আওয়ামী লীগ নীতিগতভাবে নিষিদ্ধ করেনি জামায়াতকে। তারা রাজনৈতিকভাবে বাতিল করেছিল। সরকার কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে না। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল। তাদের সংগঠন করার অধিকার আছে বলেও জানান উপদেষ্টা।

‘আদালত চত্বরে যেসব হামলা হচ্ছে আসামীদের ওপর তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়’ মন্তব্য করে আসিফ নজরুল বলেন, সাবেক মন্ত্রীসহ যাদের ওপর এমন হামলা হচ্ছে, এর দায় আওয়ামী লীগের। তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ এটা। এটা আমি কোনোভাবেই মানছি না। পুলিশ বাধা দিলেও করতে দেওয়া হচ্ছে না। সেটাও আগের সরকারের দায়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, পতনের দ্বারপ্রান্তে যখন শেখ হাসিনার সরকার, ঠিক সে সময় ১ আগস্ট জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘যেহেতু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং উহার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হইয়াছে।’

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ‘যেহেতু বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে রাজনৈতিক দল হিসাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রায়কে বহাল রাখিয়াছে। যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল; এবং যেহেতু, সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে। সেহেতু, সরকার, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল। উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসাবে তালিকাভুক্ত করিল।’

ওই দিন তাৎক্ষণিক দেয়া বিবৃতিতে সংবিধান লঙ্ঘন করে সরকারের নির্বাহী আদেশবলে বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দল ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ এর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকার ছাত্রদের অরাজনৈতিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য দেশে দলীয় ক্যাডার ও রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে গণহত্যা চালায়। সরকারের এই গণহত্যার বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষকসমাজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছে। বিশ্বসম্প্রদায় এই গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছে। সরকার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ কে নির্বাহী আদেশবলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চলমান আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবতার কল্যাণে জামায়াত ভূমিকা পালন করেছে। দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। দেশে আইনের শাসন, ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য প্রতিটি নির্বাচনে জামায়াত অংশগ্রহণ করেছে ও নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে। জামায়াতের দুইজন মন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পরিচালনায় সততা, নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। বন্যাসহ দেশের যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে জামায়াত সবসময়ই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জামায়াতের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির উদ্ভাবক জামায়াতে ইসলামী। এই কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে পরপর তিন বার সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে ভূমিকা পালন করেছে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় জামায়াতের ছয়জন নেতাকে জঙ্গীদের বোমা হামলায় প্রাণ হারাতে হয়েছে। জামায়াতের সাথে সন্ত্রাসবাাদ ও নৈরাজ্যবাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

তিনি বলেন, সরকার বিগত ১৬ বছর যাবৎ জামায়াতের উপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়েছে। জামায়াত ধৈর্যের সাথে সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। ফলে জামায়াতের প্রতি মানুষের সহানুভূতি, ভালোবাসা ও সমর্থন বেড়েছে। জামায়াত কোটি কোটি মানুষের সংগঠন। বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিকদের সভা-সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে। সরকার ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। আমরা সরকারের এই অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক ও অন্যায় সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেই জামায়াতে ইসলামীর মূল কাজ ইসলামের দাওয়াত, মানুষের চরিত্র সংশোধন ও ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজ কখনো বন্ধ হবে না। আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সকল স্তরের জনশক্তিকে ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আহ্বান জানাচ্ছি। সরকার দেশে গণহত্যা চালিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর দোষ চাপানোর যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তদ্রƒপ সরকার বিভিন্ন অঘটন ঘটিয়ে জামায়াতের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চালাতে পারে। এই ব্যাপারে দেশবাসী সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারের পাতা ফাঁদে পা দেয়া যাবে না।

তিনি আরো বলেন, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে। যুগে যুগে ইসলামের উপর কোনো আঘাতই এ আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। বর্তমান সরকারসহ কারো আঘাতেই ইসলামী আন্দোলন স্তব্ধ হবে না, ইনশাআল্লাহ। আমি দেশের প্রতিটি নাগরিককে সরকারের গণহত্যা, মানুষের অধিকার হরণ, জুলুম-নিপীড়ন ও ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ কে নিষিদ্ধ করার অসাংবিধানিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সাথে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশ, প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠন এবং বিশ্ববিবেককে বাংলাদেশের ডামি সরকারের সকল অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

https://www.dailysangram.com/post/565064