২৮ আগস্ট ২০২৪, বুধবার

বাড়ছে দুর্গতদের ভোগান্তি

বন্যাকবলিত নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরের অবস্থা এখনো অস্বাভাবিক। বিদ্যুৎবিহীন লাখো গ্রাহক। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই দুর্গত এলাকায়। ত্রাণ পাচ্ছে না প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ। পানি সামান্য কমলেও ডুবে রয়েছে বন্যাকবলিত অনেক জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

বন্যায় গতকাল পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টা ২ শিশুসহ আরো ৪ জনের মৃত্যু হওয়ায় মোট মৃতের সংখ্যা ২৭ জনে পৌঁছায়। এদের মধ্যে শুধু কুমিল্লাতে ১৪ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। দুর্গত জেলাগুলোতে বৃষ্টিপাত কমলেও উজান থেকে ঢলের পানি আসা অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে নদনদীর পানি বাড়ছে। হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা চরাঞ্চলগুলোতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর ঢেউ বেড়েছে। যশোর, খুলনাসহ এসব এলাকায় নদীভাঙন তীব্রতর হয়েছে। অনেক এলাকায় বাঁধ হুমকিতে রয়েছে। খুলনার পাইকগাছায় ভদ্রা নদীর বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে পড়ায় হাজার হাজার মানুষ বন্যা এড়াতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধটি সংস্কার করেছে। তবে এখানে বানের আশঙ্কা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে।

কুমিল্লায় বন্যায় ১৪ জনের মৃত্যু

কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লা গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান একজন। সোমবার দুপুর থেকে রাতের মধ্যে জেলার বুড়িচং, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ ও লাকসাম উপজেলায় এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এর আগের দিন রবিবার জেলার তিতাস ও বুড়িচং উপজেলায় মারা যান আরো তিনজন। বন্যার শুরু থেকে পৃথক পৃথক সময়ে মারা যান আরো ছয়জন। এর মধ্যে সোমবার দুপুরে বুড়িচং উপজেলা সদর ও পশ্চিমসিংহ এলাকায় পানিতে ডুবে হাসিবুল (১০) ও ইব্রাহিম (৪) নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়।

বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সোমবার বিকেলে নাঙ্গলকোট উপজেলার গোরকমুড়া এলাকায় সেরাজুল এবং রাতে মনোহরগঞ্জের মির্জাপুর এলাকায় বন্যার পানিতে ডুবে আরো দ্ইুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুরাইয়া আক্তার লাকী ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজালা রানী চাকমা মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার আউশপাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান মুনিরুল হকের স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৫৫)। বিষয়টি নিশ্চিত করেন লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নাজিয়া বিনতে আলম। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় ৫ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি।
কুমিল্লা দক্ষিণের পাঁচ উপজেলায় ত্রাণের দাবি

এদিকে কুমিল্লার ১৭ উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলা বেশি বন্যাকবলিত। সড়কের ক্ষত চিহ্ন ভেসে উঠছে। আক্রান্ত উল্লেখযোগ্য উপজেলাগুলো হচ্ছে বুড়িচং, আদর্শ সদরের একাংশ, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বারের একাংশ, তিতাস, লাকসাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, চৌদ্দগ্রাম ও সদর দক্ষিণের একাংশ। এ দিকে সহায়তা চেয়েছেন কুমিল্লা দক্ষিণের পাঁচ উপজেলা লাকসাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, চৌদ্দগ্রাম ও সদর দক্ষিণের বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ।

ভানবাসিদের অভিযোগ যাদের বাড়ি সড়কের পাশে তারা একাধিকবার সহায়তা পাচ্ছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে কেউ যাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতি বন্যাদুর্গত প্রতিটি এলাকার চিত্র।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মনোহরগঞ্জ ও লাকসামে সড়কের পাশে ত্রাণের গাড়ি থেমে আছে। সেখান থেকে সড়কের পাশে দাঁড়ানো মানুষজন ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন। সড়কে হাঁটু কিংবা কোমর সমান পানি থাকায় গ্রামের ভেতর যাচ্ছেন না তারা।

পাইকগাছায় স্বেচ্ছাশ্রমে ভেঙে যাওয়া বাঁধ সংস্কার
পাইকগাছা (খুলনা) জানান ভাঙনের পাঁচদিনে সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে কোনোরকম সংস্কার করা হয়েছে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটির কালীনগরে ভদ্রা নদীর বাঁধ। ভায়াবহ ভাঙনে বিধ্বস্ত পাউবোর ২২ নং পোল্ডারের আলোচিত বেড়িবাঁধটি সংস্কার হওয়া নতুন করে সেখানে পানি ঢুকার আশঙ্কা না থাকলেও ঠিক কবে নাগাদ সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নিজ ঘরে ফিরতে পারবে তা নিয়ে নানা আশঙ্কা জেঁকে বসেছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রিপন কুমার মন্ডল জানান, দিনে এবং সন্ধ্যায় নদীতে ভাটার সময়ে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি পাশ্চাত্য বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কয়েক হাজার মানুষ ভাঙনমুখে পর্যাপ্ত মাটি ফেলে রিংবাঁধ নিরাপদ করেছে।

প্যানেল চেয়ারম্যান সুকুমার কবিরাজ ও প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) সুকৃতি মোহন সরকার বলেন, দেলুটি, লতা, লস্কর, দাকোপ, সোলাদানার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এসএম এনামুল হক হাজার-হাজার নারী-পুরুষের পাঁচদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাঁধের সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

এদিকে দেলুটির ২২ নং পোল্ডারের ১৩ গ্রামের ১৫ হাজার আশ্রয়হীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এনজিওসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মঙ্গলবার সকালে দুর্গত এলাকায় ঘুরে দেখা যায় জল ও স্থলপথে এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন এলাকা থেকে খাদ্য পণ্য এনে দুর্গতদের মধ্যে সরবরাহ করছে। এর মধ্যে শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবার, কাঁচা তরকারি, সুপেয় পানি, স্যালাইন, পলিথিন, কাপড়চোপড়সহ নানা উপকরণ বিতরণ করতে দেখা যায়।

তবে ক্ষতিগ্রস্ত নলিয়ারচক, দারুণমল্লিক, বিগরদানার অনেকেই আক্ষেপের সাথে জানান, যাদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে, তারা শুধু পেয়েই যাচ্ছেন। এ সময় তারা ক্ষতিগ্রস্ত সব মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রীর সুষম বণ্টন দাবি করেন।

নোয়াখালী অফিস জানায়, ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে ধেয়ে আসা ঢলের পানিতে তলিয়ে যাওয়া নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বিদ্যুৎ না থাকায় নেটওয়ার্ক সমস্যায় এখনো অনেক এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। গতকাল মঙ্গলবার ভারী বর্ষণ বন্ধ হলেও পানি আসা কমেনি।

জেলার ৮টি উপজেলার নিমজ্জিত মানুষগুলো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়। কেউ আশপাশের ফাঁকা দালানে আশ্রয় নেয়। অনেকে অতিকষ্টে নিজ ঘরে থেকেছে। এসব মানুষ ত্রাণ সাহায্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় অন্ধকারে রাতে সর্প দংশনের ভয় বিরাজ করছে। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।

এ দিকে নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ গত রোববার কয়েকটি স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। কিন্তু সোমবার বিকেলে তাদের লাইনম্যান জাকির হোসেন (৩৪) বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়। এতে তারা পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।

শত বছরেও এ বন্যা দেখিনি : নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার নরোত্তমপুর গ্রামের ওয়াজীদ বেপারী বাড়ির ১০৫ বছর বয়সের সামছুল মিয়া একই গ্রামের আবুল কাশেম (৮৫) বলেন, আমাদের বয়সে এ ধরনের বন্যা দেখিনি।

চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বন্যার ৭ দিন অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতি সামান্য উন্নতির দিকে। উপজেলার পৌরসভা ও ১৩ ইউনিয়নে কয়েক লক্ষাধিক লোক বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তদের একটি অংশ ২৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা বানভাসী মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেকাংশে কম। বানভাসী মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সংস্থাগুলো শুকনো খাবার বিতরণ এখনো অব্যাহত রাখলেও খাদ্যসঙ্কটে ভুগছেন কয়েক হাজার শিশু।

ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে শিশুরা। আদরের সন্তানের কান্না সহ্য করতে না পেরে কাঁদছেন মায়েরা। আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি পানিবন্দী অনেক শিশুও ক্ষুধার জ্বালায় কান্না করছে। উপায়ন্তর না দেখে পানির সাথে মিশিয়ে বিস্কুট খাওয়াচ্ছেন। এসব খাবার জোরপূর্বক খাওয়ানোর ফলে অনেক শিশুই ডায়রিয়া আক্রান্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকরা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।

পশ্চিম জামালপুরে মানুষের মাঝে বন্যার শঙ্কা
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেট খুলে দেয়ার সংবাদে জামালপুরের ৭ উপজেলাবাসীর মাঝে উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেকেই পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। জামালপুরের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের বকশিগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা ভারতের সীমানার সাথে যুক্ত। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী। বিশেষ করে জামালপুর জেলার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, শরিষাবাড়ী ও পাশর্^বর্তী উত্তরের কুড়িগ্রামের রাজিবপুর, রৌমারি, কত্তিমারী, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাঘাটাসহ অন্যান্য নদী তীরবর্তী এলাকাবাসীর মাঝে ব্যাপক আলোচনা ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেকে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা ছাড়াও অনেকে একে অন্যকে ফারাক্কা খুলে দেয়ার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে দেখা যাচ্ছে। চলতি ভয়াবহ বন্যায় একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত জামালপুর জেলার অধিকাংশ উপজেলা। বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ এলাকা। বিস্তর ক্ষতি হয়েছে ফসল, বাড়ি ঘর, অবকাঠামোসহ অনেক কিছুর। এমতাবস্থায় ভারতের ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেয়ার বিষয়টি জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়াও দেশের পূর্বাঞ্চলের ১০/১১টি জেলায় ভারত থেকে পূর্ব ঘোষণা ছাড়া বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ায় বেশুমার ক্ষয়ক্ষতি ও আহত নিহত হওয়ার সংবাদে এমনিতেই হতাশাগ্রস্ত ও মর্মাহত মানুষ। ভারতের এই একঘেয়েমিপনায় মানুষ ক্ষুব্ধ তাদের ওপর। গত সোমবার ও মঙ্গলবার ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেয়ার সংবাদে দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুরসহ অনেক এলাকায় অনেক পরিবার পানি থেকে রক্ষা পেতে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আশ^স্ত করা হয়েছে ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দিলেও তেমন ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/859075