২৮ আগস্ট ২০২৪, বুধবার

ভোগান্তি কমছে না বানভাসীদের সুপেয় পানি সংকট ॥ গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে

প্রায় এক সপ্তাহ আগে ফেনীসহ দেশের যে জেলাগুলো প্লাবিত হয়েছে, সেখান থেকে এখনও পানি নামছে না; কোথাও নামা শুরু হলেও তাতে রয়েছে ধীর গতি। সংস্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্তের দুই পাশে চট্টগ্রাম বিভাগ ও ভারতের ত্রিপুরায় একই সময়ে অতিভারী বৃষ্টিপাত, পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল, সাগরে জোয়ারে স্থিতাবস্থা এবং বন্যার মধ্যে বৃষ্টি অব্যাহত থাকার কারণেই বন্যার পানি ধীরে নামছে। এজন্য সপ্তাহ পার হতে চললেও বন্যার পানি সেভাবে নামছে না। রোববারও এ ক্ষেত্রে আশানুরূপ কিছু দেখা যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, রোববার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্যা উপদ্রুত এলাকায় গড়ে ২০-৩০ সেন্টিমিটার পানি কমেছে।

কেন্দ্রটির নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান পানি ধীরে নামার দুটি কারণের কথা বলছেন। তিনি বলছেন, “এর একটা হচ্ছে তিন থেকে চার দিন ধরে ব্যাপক বৃষ্টিতে আমাদের দেশে যেমন বন্যা হয়েছে, উজানেও বন্যা হয়েছে। এ জন্যই এখন সমতল থেকে যে পানিটা নামছে, এটা ধীরে নামছে। আরেকটা কারণ হচ্ছে, এখনও বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। তবে, এটা আগের মতো ব্যাপক না কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে।
এবারের বন্যা এখন পর্যন্ত যে ১১টি জেলায় আঘাত হেনেছে, তার মধ্যে অন্যতম ফেনী। বন্যায় এই জেলার অন্যান্য এলাকার পাশাপাশি সদরের জনপদও জলমগ্ন হয়ে আছে। পুরো এলাকার ৬৫৩টি মোবাইল টাওয়ারের মধ্যে এখনও অধিকাংশ টাওয়ার অচল। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তীব্র পানির স্রোতের জন্য এবং বিদ্যুৎ না থাকায় এসব টাওয়ার সচল করা যাচ্ছে না বলে তথ্য রয়েছে। সড়ক যোগাযোগও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সব মিলে এখন এক প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জেলা ফেনী। এ জন্য ফেনীর যে মুহুরী নদী রুদ্র রূপ ধারণ করে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, সে নদীর পানি প্রবাহের কোনো তথ্য নেই পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কাছে। ফেনী ছাড়াও বন্যা উপদ্রুত অন্য জেলাগুলো হল নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও কক্সবাজার।

অধিদপ্তরের পূর্বাভাস ছিল, এই লঘুচাপটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিহারের দিকে যাবে। কিন্তু লঘুচাপটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে এটি দেশের মধ্যাঞ্চলে ২০ অগাস্ট পর্যন্ত থেকে যায়। সে সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যায় আরও বেড়ে। এরপর ২০ অগাস্ট রাতে ভারী বৃষ্টি হয়। এর প্রভাবেই ‘আকস্মিক বন্যা’র সৃষ্টি হয়।

নদী ও পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলছেন, ক্লাইমেট চেঞ্জের (জলবায়ু পরিবর্তন) কারণে সব কিছুই বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। এবার সিলেট থেকে একেবারে বান্দরবান পর্যন্ত বন্যা হয়েছে। যে লঘুচাপ ছিল, সেটা ওখানে মুভ করেছে। আগের যে বাতাসের মুভমেন্টের নির্দিষ্ট তারিখ ছিল, সেটা নাই এখন। এ জন্যই আকস্মিক এত বৃষ্টিপাত হয়েছে। জয়বায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের দিক থেকে তিনি বলেন, আগে চৈত্র সংক্রান্তিতে বৃষ্টি হতো। জৈষ্ঠ্যের শেষ তিন দিন আর বৈশাখের প্রথম চার দিন বৃষ্টি হতে দেখা যেত, কালবৈশাখী হতো। এখন সেটা হচ্ছে না।

লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও স্বজনদের বাড়ি উঠেছেন। অনেকে আবার কষ্ট করে হলেও অবস্থান করছেন বাড়িতে। চারদিকে পানি থাকায় খাটের ওপর থাকছেন, আর সেখানেই চলছে রান্নাবান্না। কোমর পানিতে যাতায়াতে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে এসব মানুষকে। এছাড়া সুপেয় পানিরও অভাব দেখা দিয়েছে। গরু-ছাগলসহ গবাদি পশু নিয়েও বিপাকে রয়েছেন গৃহস্থরা।

জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর পৌরসভার লামচরী, মধ্য বাঞ্চানগর, শিশু পার্ক এলাকা ও লাহারকান্দি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দী। এসব এলাকার ১২ হাজার ৭৫০ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। তবে অধিকাংশ মানুষ নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে স্বজনদের বাড়ি গিয়ে উঠেছেন।

নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রধান সড়কের আশপাশে সহযোগিতা পেলেও প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে পৌঁছায়নি ত্রাণ সহায়তা। সেখানে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট। স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি ক্ষুধার্ত অধিকাংশ শিশু। ফলে অধিকাংশ জায়গায় দেখা দিয়েছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। জানা গেছে, নোয়াখালীর ৮ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। ১ হাজার ১৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন দুই লাখ ১৬ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে নগদ ৪৫ লাখ টাকা, ৮৮২ টন চাল, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও ৫ লাখ টাকার গো খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। নোয়াখালী জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই বন্যার পানি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার বন্যার পানি। এসব উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণই এখন পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ফলে বন্যার্ত মানুষ সীমাহীন কষ্টে দিন যাপন করছেন।

এদিকে চলমান বন্যায় দেশের ১১ জেলায় এখন পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন মানুষ। চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যায় মোট ২৭ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে কুমিল্লায় ১০ জন, চট্টগ্রামে ৫ জন, নোয়াখালীতে ৫ জন, কক্সবাজারে ৩ জন এবং ফেনী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে মারা গেছেন। ত্রাণ উপদেষ্টা বলেন, ১১ জেলায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন। পানিবন্দী ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার।

https://www.dailysangram.com/post/564966