ভয়াবহ বন্যায় বিধ্বস্ত ১১ জেলার মানুষের দুর্ভোগ, আতঙ্ক ও হাহাকার কাটছে না। টানা ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি কয়েকটি জেলায় কমলেও নতুন নতুন এলাকা এখনো প্লাবিত হচ্ছে। অনেক এলাকায় ত্রাণসামগ্রী ও বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে হাহাকার চলছে। পানি কমে আসা এলাকাগুলোতে স্রোত বেশি থাকায় ভয়াবহভাবে নদীভাঙন শুরু হয়েছে। ঢলের পানিতে খরস্রোতা হওয়ায় তিস্তার ব্যাপক ভাঙনে লালমনিরহাটের ৩০টি পরিবার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকিতে রয়েছে ১০০ পরিবার। পানি কমে আসা এলাকাগুলোতে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণকার্যক্রম প্রচুর হলেও কোনো কোনো এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। গতকাল পর্যন্ত বানের পানিতে ২০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিখোঁজ রয়েছেন আরো দু’জন। শুধু মিরসরাই, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরেই এখনো ১৭ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে রয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ভয়াবহ এই বন্যায় ৫২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎহীন অনেক এলাকায় স্থাপিত হয়নি মোবাইল নেটওয়ার্ক। তৃণমূল জনপদের মানুষ বেশি দুর্ভোগে।
লক্ষ্মীপুরে বন্যার আরো অবনতি : পরিস্থিতি ভয়াবহ
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, লক্ষ্মীপুরে গতকাল রাতভর বৃষ্টিতে বন্যার আরো অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে নিম্নাঞ্চলে ৩ ফুট পানি বেড়েছে। গত শুক্রবার বিকেল থেকে জেলার অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। এ ছাড়া অনেক জায়গায় বন্যাকবলিত মানুষ ত্রাণ পায়নি। দ্রুত ত্রাণ পাঠানোর দাবি জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। এতে দুই থেকে তিন ফুটের বেশি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পাঁচটি উপজেলা, চারটি পৌরসভা ও উপকূলের ৪০টি এলাকায় এখনো পানিবন্দী রয়েছে সাড়ে ৭ লাখ মানুষ। গত দুই দিন ধরে ফেনী ও নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী ও ডাকাতিয়া খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরে ঢুকে পড়ছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, মান্দারী, বাঙ্গাখাঁ, উত্তর জয়পুর ইউনিয়নসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রায় চার ফুট পানিতে ডুবে আছে জনপদ।
রামগতি ও কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা-হাজীগঞ্জ বেড়ির পশ্চিম পাশে ভুলুয়া নদীতে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে প্রায় ২৫ দিন ধরে পানিতে ডুবে আছে বিস্তীর্ণ জনপদ। রামগতি-কমলনগর ও নোয়াখালীর আন্ডারচর ও চরমটুয়া গ্রামের তিন লক্ষাধিক মানুষ এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। জলাবদ্ধতার এ পানি কোথাও সরছে না।
এদিকে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগবালাই। এখন পর্যন্ত জেলায় বিভিন্ন আশ্রয়ণ কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ। ওই সব জায়গায়ও শুকানো খাবার দিয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সব কিছু মিলে এখনো দুর্ভোগের সীমা নেই তাদের। বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো বন্যার্তদের মধ্যে শুকনো খাবার ও চাল-ডালসহ নানা সামগ্রী বিতরণ করলেও তা অপ্রতুল। অনেক জায়গায় পৌঁছায়ইনি ত্রাণ।
নোয়াখালীতে বন্যার পরিস্থিতি আরো অবনতি
নোয়াখালী অফিস জানায়, ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে ধেয়ে আসা ঢলের পানিতে তলিয়ে যাওয়া নোয়াখালীবাসীর বন্যার পরিস্থিতি আরো অবনতি ঘটছে। অব্যাহত ধেয়ে আসা পানিতে নতুন নতুন অঞ্চল প্লাবিত হয় । গত ৪ দিন বৃষ্টি বন্ধ থাকার পর গত শনিবার রাত থেকে রোববার পর্যন্ত মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে। নোয়াখালী জেলা আবহাওয়া অধিদফতরের উচ্চ পর্যবেক্ষক আরজুল ইসলাম বলেন, শনিবার দুপুর ১২টা থেকে রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ সামান্য বৃষ্টিতে বন্যার অবনতি ঘটতে পারে না। আগামী ২/৩ দিন হালকা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে । এসব বৃষ্টিতে বন্যা হবে না। ধেয়ে আসা পানির কারণে বন্যা দেখা দিচ্ছে। জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ক্লুজার খুলে দেয়ায় ক্লজার দিয়ে সাগরের দিকে নোয়াখালী ও ফেনীর পানি নিষ্কাশন হচ্ছে। কিন্তু কার্যত তার কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
এ দিকে বন্যা দুর্গত মানুষের মধ্যে তীব্র বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া অনেক মানুষ সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। এতে সাপ আতঙ্কে রয়েছে বন্যাকবলিত মানুষদের মধ্যে।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে বন্যার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছে ১০৮ জন। এ ছাড়া গত তিন দিনে নোয়াখালীতে ৬৩ জনকে সাপে কেটেছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে সাপে কেটেছে ২৮ জনকে।
মিরসরাইয়ে ২ লাখ মানুষ পানিবন্দী
মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, স্বরণকালের ভয়াবহ বন্যায় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে এখনো পানিবন্দী রয়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। কয়েকটি এলাকায় পানি কিছুটা কমলেও নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে অন্যান্য এলাকা। টানা চার দিন বিভিন্ন বহুতল ভবনে আটকে রয়েছে শত শত মানুষ। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে এখানকার ফেনী নদীর পানির উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া গত বুধবার থেকে এখানকার ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ১৬৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। রোববারও কয়েকটি ইউনিয়নে ক্রমাগত পানি বাড়ায় অনেক মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। বানের পানিতে ভেসে গেছে এখানকার হাজার কোটি টাকা মূল্যের মাছ। যা চট্টগ্রামের মৎস্য খাদ্য চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ করত।
খুলনায় বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় ভারী বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অবিরাম বৃষ্টিতে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। একটানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে নগরীর রাস্তাঘাট। নগরীর নি¤œাঞ্চলের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও তলিয়ে গেছে। গত দু’দিনের বিরামহীন বৃষ্টির কারণে শ্রমজীবী মানুষ কাজের জন্য বাইরে বের হতে পারছে না। ফলে তাদের সংসারে খাবারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এদিকে, সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ, স্কুল,মাদ্রাসা ও কলেজগামী শিক্ষার্থী এবং চাকরিজীবীরা।
গত শনিবার প্রায় সারা দিন কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি আবার কখনো ভারী বৃষ্টি হয়। গভীর রাত থেকে শুরু হয় একটানা বৃষ্টিপাত। এ রকম বৃষ্টি চলে রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এরপর বৃষ্টি একটু কমলেও আকাশ ছিল কালো মেঘে ঢাকা।
গতকাল রোববার সকালে দেখা যায়, নগরীর রয়্যাল মোড়, স্যার ইকবাল রোডের বাইতিপাড়া এলাকা, সাতরাস্তা মোড়, বড় মির্জাপুর, টুটপাড়া, মুজগুন্নি, রায়ের মহলসহ বিভিন্ন এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচলে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়।
কসবা-আখাউড়ায় পরিস্থিতির উন্নতি
বাসস জানায়, জেলার আখাউড়ায় ও কসবায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ফলে নতুন করে আর কোনো গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়নি। বন্যায় বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে এখনো বেশ কয়েকটি গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
ফেনীতে বন্যার পানি কমছে
বাসস আরো জানায়, ফেনীতে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়াতে ইতোমধ্যে বন্যার পানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফেনী শহরেও পানি কমছে। তবে, সোনাগাজী, দাগনভূঞাতে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে রয়েছে। আজ রোববার তথ্যগুলো ফেনী জেলা প্রশাসন সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তিস্তায় ব্যাপক ভাঙন নদীতে কয়েকটি গ্রাম
সাব্বির আহমেদ লাভলু (লালমনিরহাট) জানান, লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের হরিণচড়া গ্রামে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। তিস্তায় পানি বাড়তে থাকায় দেখা দিয়েছে এ নদীভাঙন। গত সাত দিনে তিস্তা নদীর ডান তীরের এ গ্রামে নদীভাঙনে ৩০টি বসতভিটা ভেঙে গেছে। ভাঙন হুমকিতে রয়েছে আরো শতাধিক পরিবারে বাড়িঘর। নদীতে চলে গেছে ৩০০ বিঘা জমির ধান সবজিসহ ফসলের ক্ষেত। লোকজন ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন প্রতিরোধে জিওব্যাগ ফেললেও তা কোনো কাজে আসছে না।
হরিণচড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ, মাহবুব হোসেন, ফারুক মিয়া জানান, তিস্তার বামতীরে নদীভাঙন রোধে সংরক্ষণ কাজ হলেও ডানতীরে কোনো সময় কাজ হতো না। তা ছাড়া নদীও ছিল অনেক দূরে। কিন্তু বর্তমানে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে ডানতীর দিয়ে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের ফলে কৃষি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীভাঙনের কবলে পড়ছে।
ভাঙন হুমকিতে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদসহ বাজার। এ গ্রামটিতে ১২ হাজার লোকের বসবাস রয়েছে। নদীভাঙনে একেকজন তিন থেকে পাঁচবার পর্যন্ত বসতভিটা সরিয়েছেন। জমি জায়গা নদীতে বিলীন হওয়ার কারণে অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব এসব মানুষ উঁচু সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন। যাদের একসময় সহায়সম্বল ছিল। সামাজিক অবস্থা সচ্ছল ছিল। অভাব অনটন ছিল না। কিন্তু তিস্তার বন্যা আর নদীভাঙনে নিঃস্ব এখন এসব পরিবার। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই তাদের। ভিটেমাটি হারিয়ে পথে বসেছে নদীভাঙনের শিকার কয়েক হাজার মানুষ। স্থানীয় ইউপি সদস্য এমদাদ মিয়া জানান, ভাঙন প্রতিরোধে তারা নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করে বালুর বস্তা দিয়ে বাঁধ দিয়েছে। কিন্তু তিস্তার প্রবল পানির স্রোতে সে প্রতিরক্ষা বাঁধও ভেঙে গেছে। এখানে বর্তমানে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
ত্রাণের জন্য হাহাকার কুমিল্লার দক্ষিণ অঞ্চলে
নাঙ্গলকোট (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, ভারতীয় ঢলের পানি ও অবিরাম বৃষ্টিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে কুমিল্লা। এমতাবস্থায় নানা পদে হয়রানির শিকার হতে যাচ্ছে এখানকার বাসিন্দারা। ডাকাতির ভয়ে কেউ আবার নিরাপদ আশ্রয়ে না গিয়ে রয়েছেন বাড়িতে। আর বন্যার্তদের সহায়তায় দেশবাসী এক হয়ে যেভাবে ত্রাণ নিয়ে ছুটছেন কুমিল্লা জেলার বুড়িচংয়ে। সেভাবে ত্রাণ মিয়ে যাচ্ছে না কুমিল্লার দক্ষিণ অঞ্চলে। এতে দক্ষিণের বানভাসিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হাহাকার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার দক্ষিণ অঞ্চল নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, লাকসাম ও চৌদ্দগ্রাম। তার মধ্যে চৌদ্দগ্রাম ও লাকসাম উপজেলার বন্যার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তুলনামূলক স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছ থেকে ত্রাণ পাচ্ছেন তারা। কিন্তু নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ তার উল্টো। বৃষ্টি কমলেও এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। এতে পানিবন্দী রয়েছে অন্তত তিন লাখ মানুষ। তাই ওই সব এলাকায় বানভাসির মধ্যে চলছে ত্রাণের হাহাকার।
দেখা যায়, জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলাই বানের পানিতে নিমজ্জিত। পানিবন্দী অন্তত ৮ লাখ মানুষ। এসব উপজেলার মধ্যে সারা দেশ থেকে ত্রাণ ও উদ্ধার কর্মীরা দাউদকান্দি, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া এলাকায় বেশি প্রবেশ করছেন। ত্রাণ পাচ্ছেন না পানিবন্দী নাঙ্গলকোট, লাকসামের কিছু এলাকা ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার লাখ লাখ পানিবন্দী মানুষ।
তিতাসে বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু
দাউদকান্দি (কুমিল্লা) প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রোববার সকাল ১০টায় তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের বাঘাইরামপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলো বাঘাইরামপুর গ্রামের মুক্তার হোসেনের বড় মেয়ে, সামিয়া আক্তার (১০) ও একই গ্রামের মনির হোসেনের মেয়ে আয়শা আক্তার (৮)। সামিয়া আক্তার স্থানীয় খাতুন কোবরা মহিলা মাদরাসার তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
জানা যায়, বন্যায় প্লাবিত সড়কে খেলতে গিয়ে স্রোতের তোরে পড়ে সামিয়া ও আয়শা নিখোঁজ হয়। পরে দাউদকান্দি ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ঘটনাস্থলে এসে সামিয়া ও আয়শাকে উদ্ধার করে তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিলে চিকিৎসক দু’জনকেই মৃত ঘোষণা করেন।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫২ লাখ মানুষ : ত্রাণ সচিব
বাসস জানায়, বন্যায় নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: কামরুল হাসান। গতকাল রোববার দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের অবহিতকরণ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
কামরুল হাসান বলেন, বিগত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাগুলোতে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি সমতলে হ্রাস অব্যাহত আছে। ফলে বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে। বন্যার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, বন্যায় দেশের ১১ জেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবার। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৫২ লাখ মানুষ।
সচিব জানান, ১১টি জেলার ৭৩ উপজেলা ইউনিয়ন-পৌরসভা ৫৪৫ বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ১৮ জন, নিখোঁজ রয়েছেন দুইজন। পানিবন্দী ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তিন হাজার ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে চার লাখ ১৫ হাজার ২৭৩ জন এবং ২২ হাজার ২৯৮টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ৭৪৮টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সবপর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ১১ জেলায় তিন কোটি ৫২ লাখ টাকা, ২০ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা ও অন্যান্য খাবার, ৩৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং ৩৫ লাখ টাকার গোখাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে।
ত্রাণ সচিব বলেন, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিক্যাল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে সমন্বয় করে একসাথে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কামরুল হাসান বলেন, ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম উপজেলায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌ ও সড়ক পথে এবং তাদের হেলিকপ্টারসহ বিমানবাহিনী, র্যাব ও বিজিবির হেলিকপ্টারযোগে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রম চলমান আছে।
ফেনীতে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ও জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। পাশাপাশি স্থানীয় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা নির্দেশনা দিচ্ছেন।