২৬ আগস্ট ২০২৪, সোমবার

পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে পাচ্ছে না

গতকাল সামান্য কিছু ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে ফেনীতে সাঁতার কেটে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়ার চেষ্টা করছে ছোট শিশুটি
স্টাফ রিপোর্টার : বন্যায় নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: কামরুল হাসান। গতকাল রোববার দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের অবহিতকরণ উপলক্ষে আয়োজিত এক সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। কামরুল হাসান বলেন, বিগত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাসমূহে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস অব্যাহত আছে। ফলে বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে।

বন্যার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, বন্যায় দেশের ১১ জেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবার। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৫২ লাখ মানুষ। সচিব জানান, ১১টি জেলার ৭৩ উপজেলা ইউনিয়ন-পৌরসভা ৫৪৫ বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ১৮ জন, নিখোঁজ রয়েছেন দুইজন। পানিবন্দী ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৪ লাখ ১৫ হাজার ২৭৩ জন এবং ২২ হাজার ২৯৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ৭৪৮টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে বলেও জানান তিনি।

বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ১১ জেলায় মোট ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ২০ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা ও অন্যান্য খাবার, ৩৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং ৩৫ লাখ টাকার গো-খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে।

ত্রাণ সচিব বলেন, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিক্যাল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে সমন্বয় করে একসাথে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

কামরুল হাসান বলেন, ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম উপজেলায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌ ও সড়ক পথে এবং তাদের হেলিকপ্টারসহ বিমানবাহিনী, র‌্যাব ও বিজিবির হেলিকপ্টারযোগে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রম চলমান আছে।

ফেনীতে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ও জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। পাশাপাশি স্থানীয় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা নির্দেশনা দিচ্ছেন।

এদিকে নতুন করে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় নোয়াখালীর সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শনিবার দিনে বৃষ্টি না হওয়ায় কিছু এলাকার বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও রাতের বৃষ্টিতে সেটি আবার বেড়ে গেছে। রোববার সকাল থেকেও জেলার সর্বত্র হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হয়। পাশাপাশি পাশের ফেনী জেলার বন্যার পানি ঢুকে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, বন্যায় এরই মধ্যে নোয়খালী জেলার ২০ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া জেলার আটটি উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া বন্যার পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায় গতকাল একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে জেলায় নিহতের সংখ্যা চারজনে দাঁড়াল।

জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টায় জেলায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। জেলা শহর মাইজদী, চাটখিল ও সেনবাগের অনেক এলাকা এখনো পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। জেলার চাটখিল উপজেলার বন্যা পরিস্থিতিকে মারাত্মক বলে উল্লেখ করেছেন সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী এহসান উদ্দিন। তিনি বলেন, গত রাতে বৃষ্টি ও উজানের পানি ধেয়ে আসার কারণে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এতে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের সংখ্যা ২০ হাজারে ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে। তাই চাটখিলে ত্রাণসহায়তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনের সড়কে প্রায় হাঁটুপানি দেখা গেছে। শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকার বাসিন্দা বিবি খোদেজা বলেন, বাড়ির উঠানে এখনো কোমরসমান পানি। ঘরের ভেতর হাঁটুপানি। রান্নাঘরের চুলা ডুবে গেছে অনেক আগে। বাইরে থেকে কিনে আনা শুকনা খাবার এবং প্রতিবেশীদের দেওয়া খাবার এই টিকে আছেন কোনোরকম। রাতের বৃষ্টিতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বন্যাকবলিত সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, চাটখিল ও সদর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক পরিবারের কাছে এখনো সরকারি–বেসরকারি সহায়তা পৌঁছায়নি। বুকসমান পানির কারণে এসব এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা যাচ্ছে না।

এদিকে কুমিল্লা জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলাই বানের পানিতে নিমজ্জিত। পানিবন্দি লাখো মানুষ। এসব উপজেলার মধ্যে সারাদেশ থেকে ত্রাণ ও উদ্ধার কর্মীরা দাউদকান্দি, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া এলাকায় বেশি প্রবেশ করছেন। ত্রাণ পাচ্ছেন না পানিবন্দি নাঙ্গলকোট, লাকসামের কিছু এলাকা ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষ। রোববার সকালে এমন অভিযোগ করেছেন সে সব উপজেলার বানভাসি মানুষেরা। তাদের অভিযোগ প্রচার-প্রচারণা কম থাকায় ব্যক্তি ও সংগঠন কেন্দ্রীক ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ করা বাইরের স্বেচ্ছাসেবকরা একদম আসছেন না।

উপজেলা তিনটির মধ্যে নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা একেবারেই নোয়াখালীর পাশে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যারাই ত্রাণ সহায়তা নিয়ে কুমিল্লায় আসছেন, তাদের সবাই কাছাকাছি অঞ্চল বুড়িচং বা আশপাশের উপজেলাগুলোতে প্রবেশ করছেন। মহাসড়ক থেকে দূরের উপজেলা হওয়ায় সেখানের বানভাসিদের কাছে যাচ্ছেন না কেউ। স্থানীয়দের অভিযোগ, সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার প্রচারণা কম থাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব এলাকার মানুষ।

গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করার খবরে বুড়িচং উপজেলার প্লাবনের খবর বেশি প্রচার হওয়ায় সারাদেশ থেকে দলে দলে নৌকা ও ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে প্রবেশ করছেন সেখানেই। কিন্তু ডাকাতিয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে জেলার দক্ষিণের তিন উপজেলা। এসব এলাকায় অন্তত আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি আছেন। সরকারি ত্রাণ সেসব মানুষদের জন্য খুবই অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন সেসব এলাকার বানভাসিরা।

জাহাঙ্গীর আলম নামের নাঙ্গলকোট উপজেলার এক বানভাসি বলেন, আমাদের নাঙ্গলকোট দুর্গম এলাকা হওয়ায় এখানে কোনো সাংবাদিকও আসেন না। আমরা যে পানিতে তলিয়ে আছি, আমাদের খবরগুলো প্রচার করেন না। আমাদের এদিকে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানির খুব প্রয়োজন। সরকারি সহায়তা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। তারেক আহমেদ নামের আরও এক বানভাসি বলেন, নাঙ্গলকোটে শুধু পানি আর পানি। অনেক অসুস্থ মানুষ, বৃদ্ধ মানুষ, গর্ভবতী নারীও আটকে আছ্ েতাদের উদ্ধার করা খুব দরকার। পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তাও। দেশের মানুষদের এদিকটার প্রতি একটু মনযোগ দেওয়ারও অনুরোধ করব।

নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লাকী বলেন, নাঙ্গলকোটে ত্রাণ সরবরাহে কিছুটা সংকট আছে আমরা সেটা স্বীকার করছি। এ উপজেলার কিছু জায়গায় একেবারেই পৌঁছানো যাচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে তাদের কাছে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার্। বর্তমানে নাঙ্গলকোটে উদ্ধারের মতো পরিস্থিতি শুধু একটি জায়গায় আছে। সেখানে নৌকা ও স্পিডবোট পাঠিয়ে সে এলাকার লোকদের উদ্ধার করা হবে।

মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) উজালা রানী চাকমা বলেন, এখানে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে। পানি কিছুটা বেড়েছে। মনোহরগঞ্জ উপজেলার অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে যেগুলোতে নৌকা ছাড়া যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমাদের কাছে নৌকার প্রচুর সংকট রয়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পাঠিয়ে সেসব এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন একটা মানুষও অভুক্ত না থাকে।

অন্যদিকে ফেনী সদরের বিরিঞ্চি, বারাইপুর, সুলতানপুর, স্টেডিয়াম, পলিটেকনিক, ফুলেশ্বর, একাডেমি, ফুলগাজি রোডসহ নিচু অঞ্চলগুলোতে হাঁটু পানি থেকে কোথাও এখনো বুক সমান পানি। পাঁচগাছিয়া রোডের কিছু এলাকায় ৫-৬ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে। বিশেষ করে পুরাতন পুলিশ কোয়ার্টার এলাকা। বিদ্যুৎ নেই, আর বাংলালিংক ছাড়া কোনও মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক নেই। শহরে খাবার পানি, শিশু খাদ্য ও মোমবাতি নেই। ওষুধেরও টানাটানি চলছে। পাল্লা দিয়ে বেশি দামে শুকনো খাবার, মোমবাতি, পানি বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। চারদিকে শুধু মানুষের আহাজারি। প্রচুর ত্রাণ নিয়ে গিয়েও সঠিকভাবে বিতরণ করতে পারছেন না অনেকে। আবার কেউ কেউ নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে দর্গত এলাকায় গিয়ে মানুষের হাতে ত্রাণ পৌঁছাতে পেরেছেন ‘ক্ষুধা নিবারণ’ নামের একটি সংগঠন। সংগঠনের ফাউন্ডার ইঞ্জিনিয়ার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, শনিবার আমরা প্রচুর খাবার পানি, শুকনো খাবার, মোমবাতি, দিয়াশলাই, স্যানিটারি প্যাড, শিশু খাদ্য- এসব নিয়ে এসেছি। সুষ্ঠুভাবে দিতে পেরেছি।

নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ত্রাণ বিতরণকালে অনেক কষ্ট হয়েছে। প্রচুর পানি, অপরিচিত জায়গা, ত্রাণ বহন করা সবই কষ্টকর ছিল। তবে স্বেচ্ছাসেবকরা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। আরেকটি ব্যাপার, যাদের ত্রাণ সহযোগিতা করেছি, কারা কেউ গরিব নন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার।

দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন বার্তা দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। বলা হয়েছে, ফেনী ও কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। রোববার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হানের স্বাক্ষর করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাগুলোতে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি। এতে উজানের নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। ফলে বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নি¤œাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ফেনীর নি¤œাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর কাছাকাছি উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের শঙ্কা নেই। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের পূর্বাঞ্চল ও এর কাছাকাছি উজানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ সময় এ অঞ্চলের কুমিল্লা জেলার গোমতী নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং সংলগ্ন নি¤œাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। বিজ্ঞপ্তিতের আরও বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। উল্লেখ্য, দেশের ১১ জেলায় বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এতে ১৮ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের ৫ জন, কুমিল্লার ৪ জন, নোয়াখালীতে ৩ জন, কক্সবাজারে ৩ জন এবং ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষীপুর জেলায় একজন করে মারা গেছেন।

লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, বাড়ছে পানি
লক্ষ্মীপুর সংবাদদাতা: লক্ষ্মীপুরে গতকাল রাতভর বৃষ্টিতে বন্যার আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে কোথাও এক ফুট আবার কোথাও দুই ফুট পানি বেড়েছে বলে জানিয়েন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ফেনী ও নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী ও ডাকাতিয়া খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরে ঢুকে পড়ছে। এদিকে অনেক জায়গায় বন্যাকবলিত মানুষ ত্রাণ পায়নি। দ্রুত ত্রাণ পাঠানোর দাবি জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। এতে দুই থেকে তিন ফুটের বেশি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পাঁচটি উপজেলা, চারটি পৌরসভা ও উপকূলের ৪০টি এলাকায় এখনও পানিবন্দি রয়েছে সাড়ে ৭ লাখ মানুষ।
গত দুই দিন ধরে ফেনী ও নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী ও ডাকাতিয়া খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরে ঢুকে পড়ছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, মান্দারী, বাঙ্গাখাঁ, উত্তর জয়পুর ইউনিয়নসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রায় চার ফুট পানিতে ডুবে আছে জনপদ।

রামগতি ও কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা-হাজীগঞ্জ বেড়ির পশ্চিম পাশে ভুলুয়া নদীতে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে প্রায় ২৫ দিন ধরে পানিতে ডুবে আছে বিস্তীর্ণ জনপদ। রামগতি-কমলনগর ও নোয়াখালীর আন্ডারচর ও চরমটুয়া গ্রামের তিন লক্ষাধিক মানুষ এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। জলাবদ্ধতার এ পানি কোথাও সরছে না।

এদিকে বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগবালাই। এখন পর্যন্ত জেলায় বিভিন্ন আশ্রয়ণ কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ। ওইসব জায়গায়ও শুকানো খাবার দিয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সব কিছু মিলে এখনো দুর্ভোগের সীমা নেই তাদের। বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো বন্যার্তদের মধ্যে শুকনো খাবার ও চাল-ডালসহ নানা সামগ্রী বিতরণ করলেও তা অপ্রতুল। অনেক জায়গায় পৌঁছাইয়নি ত্রাণ।

ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে একাধিক পরিবার জানিয়েছে, কোনো ধরনের ত্রাণ পাচ্ছে না তারা। দ্রুত সবাইকে ত্রাণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।
রামগতি আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষক মোঃ সোহরাব হোসেন বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৭০ মিলিমিটার। বন্যার অবনতি হচ্ছে। আরও বৃষ্টি কয়েকদিন থাকবে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাহিদ উজ জামান বলেন, ‘গত দুই দিনে পানি অনেক বাড়ছে। বিশেষ করে গত ২৪ ঘণ্টায় কোথাও এক ফুট আবার কোথাও দুই ফুট পানি বাড়ছে। এরই মধ্যে মজুচৌধুরীর হাটের স্লুইসগেটে সব দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। জোয়ারের সময় দরজা বন্ধ থাকে। ফেনী ও নোয়াখালীর পানি ডাকাতিয়া রহমতখালী নদী হয়ে লক্ষ্মীপুর প্রবেশ করছে। ফলে বন্যার আরও অবনতি হচ্ছে।’

ফটিকছড়ি সংবাদদাতা : ফটিকছড়িতে স্মরণ কালের ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানি নামার সাথে সাথে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ফুটে উঠছে। বাড়িঘর,রাস্তাঘাট,নদীর বাঁধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ক্ষতির চিহ্ন। এছাড়া পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে মারা গেছে চারজন।

উপজেলার বাগানবাজর,দাঁতমারা,নারায়নহাট,ভুজপুর,হারুয়ালছড়ি,নাজিরহাট, সুয়াবিল, সুন্দরপুর ও পাইন্দং সহ প্লাবিত নিচু এলাকার ঘর-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্ষতগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। কারও থাকার ঘর, কারও আবার রান্না ঘর। কারও কারও পুরো ঘর বিলীন হয়ে গেছে বন্যায়।

শুক্রবার রাত থেকে দ্রুতগতিতে পানি কমতে শুরু করেছে। সূর্যের আলো দিয়ে শনিবার সকাল শুরু। বন্যা প্লাবিত এলাকার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট থেকে সরে যাচ্ছে পানি। আজ কালের মধ্যে বেশিরভাগ এলাকা থেকে পানি নেমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সরজেমিনে দেখা যায়, বন্যা কবলিত গ্রামগুলো থেকে পানি নেমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র বা নিরাপদ স্থান থেকে মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। অনেকে ঘরে ঢুকে আসবাবপত্র পরিষ্কার ও শুকানোর কাজ করছে। বিশেষ করে মাঠির ঘর ও কাঁচা ঘরের বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। ঘর বাড়ির আঙ্গিনা কাঁদাযুক্ত হয়ে বসবসাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

বাগানবাজর এলাকার মুহি উদ্দিন বলেন, বাগান বাজার ইউনিয়নস্থ আমাদের এলাকার অধিকাংশ মাটির ঘর থাকার কারণে প্রায় ৫ শতের অধিক ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ধ্বসে পড়ে। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে।

সুন্দরপুর এলাকায় বাসিন্দা দেলোয়ার বলেন, দুইদিন ধরে ঘর থেকে বের হতে পারিনি। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। ঘরের চারপাশে ছিল পানি আর পানি। অনেকে বুক সমান পানিতে এসে খাবার দিয়ে গেছে, এসব খেয়েই ছিলাম। রান্না হয়নি ঘরে। আজকে পানি কমে যাওয়ায় ঘরের জিনিসপত্র বের করে রোদে শুকাতে দিচ্ছি।

বন্যাকবলিত এলাকার হাটবাজারের বিভিন্ন দোকানেও পানি প্রবেশ করে ক্ষতি হয়েছে অনেক। কয়েকদিন ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ থাকার পর আবারো স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

চট্টগ্রাম-খাগগছড়ি সড়ক, গহিরা-হেয়াকো সড়ক, নাজিরহাট-কাজিরহাট সড়ক, কাটিরহাট-সমিতিরহাট-আজাদীবাজার,সমিতিরহাট-নানুপুর সড়কসহ বিভিন্ন গ্রামীন সড়ক পানিতে ডুবে এবং পানির স্রোতে ভেঙ্গে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম-খাগগছড়ি সড়কের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি ছোট বড় গর্তের। ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে।

এদিকে পানিতে তলিয়ে গেছে শত শত একর চাষের জমি,পোল্ট্রী ফার্ম ডেইরি ফার্ম। উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন,উপজেলা চাষাবাদদের ব্যপক ক্ষতি হয়েছ। পানি সরে গেলে ক্ষতির পরিমান নিরুপণ সম্ভব হবে।
হালদা,ধুরুং,ফেনী,সর্তাসহ বিভিন্ন খাল নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে পড়েছে।

এতে হালদার বাঁধের ২২ টির অধিক স্থানে ভেঙ্গেছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল হোসেন বলেন,আমরা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে প্রাথমিক ভাবে ২০হাজারের অধিক পরিবারের লক্ষাধিক জনসাধারন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৬০০ ঘর পুরোপুরি বিদ্ধস্ত,সাড়ে ৭ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্তের তথ্য আমাদের কাছে এসেছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন,পানি বেশ দ্রুত নেমে যাচ্ছে, বাগানবাজার, নারায়াণহাট, হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল ইউনিয়নে অনেক কাঁচা ঘর ও মাটির ঘর ভেংগে পড়েছে। উপজেলা জুড়ে রাস্তাঘাটসহ কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটি পুরোপুরি তালিকা না করে বলা যাবেনা।

তিনি আরো বলেন,দুর্গতদের জন্য দুই হাত ভরে সাহায্য এক অভাবনীয় মানবিক দেশের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
পুনর্গঠনে সহযোগিতা করার যাদের ইচ্ছা তারা এই বিষয়ে কাজ করতে পারেন তবে অবশ্যই অভারল্যাপিং পরিহার করতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করছি।

উল্লেখ্য,ফটিকছড়িতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। গত বৃহষ্পতিবার থেকে শুরু হওয়া বন্যায় উপজেলার ২ পৌরসভাসহ সবকটি ইউনিয়নের কমবেশি প্লাবিত হয়েছে।

উপজেলা জুড়ে বন্যা দুর্গত মানুষের বাঁচার আকুতি,হাহাকার,আতংকে নির্ঘুম ভয়াল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তবে স্থানীয় ও উপজেলার বাহিরের সেচ্ছাসেবী ও মানবিক সংগঠন গুলোর ঝাঁপিয়ে পরা ছিল চোখে পড়ার মতো। এখনো সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ উপজেলা প্রশাসন,আইন শৃংঙ্কলা বাহিণীর পাশাপাশি এসব সংগঠন ও সেচ্ছাসেবীদের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। যার কারনে মানুষের জান মালের অনেক ক্ষতি রোধ করা গেছে বলে সচেতন মহল মন্তব্য প্রকাশ করেন।

জুড়ী (মৌলভীবাজার) : তৃতীয় দফায় বন্যার কবলে পড়ল মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা। পানি বন্দি হয়ে পড়েছে হাজারও মানুষ।

রোববার (২৫ আগস্ট) মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার ১৭৪ সে.মি, উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়েছে বহু বাড়িঘর।

জুড়ী উপজেলার ফুলতলা গ্রামের সংবাদকর্মী হোসাইন রুমেল বলেন, ফুলতলা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ছে পানি, কোনাগাও গ্রামের মানুষজন গবাদিপশু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠছেন। এছাড়াও জুড়ী-ফুলতলা সড়কের বেশ কিছু অংশ তলিয়ে গেছে পানিতে। যোগাযোগে দেখা দিয়েছে চরম ভোগান্তি।

এব্যাপারে জুড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার বাবলু সুত্রধর বলেন, জুড়ী উপজেলার ৩৮ টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ৫ হাজার পরিবারের ২০ হাজার মানুষ পানি বন্দি। প্রাথমিক অবস্থায় কারো বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হলে নিকটস্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়ার জন্য বলেছি।

https://www.dailysangram.com/post/564809