২৫ আগস্ট ২০২৪, রবিবার

এক কলঙ্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক : সম্মানিত ব্যক্তিদের করতেন অপদস্থ

ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত এলাকা থেকে আটক হওয়া আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শাসসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তার নানা কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত হন। তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, দেশের বিশিষ্ট নাগরিক এবং সরকারবিরোধীদের তলব করে তার আদালতে এনে অপমান অপদস্থ করতেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা মনে করেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সুপ্রিম কোর্টের একটি কলঙ্কিত নাম। তিনি পলাতক শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের ঘৃণিত প্রতিচ্ছবি। আইনজীবীরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হওয়া উচিত, যাতে অন্য কোনো বিচারপতি মানিকের মতো হতে না পারেন।

ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় শুক্রবার রাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর হাতে আটক হন তিনি। এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, সাবেক বিচারপতি মানিকের গলায় গামছা বেঁধে হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন একজন ব্যক্তি। একজন বিজিবি সদস্য তাকে জিজ্ঞেস করছেন, আপনার বাড়ি কোথায়?

জবাবে তিনি বলেন, মুন্সিগঞ্জ। এরপর নাম জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমার নাম বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তখন ওই বিজিবি সদস্যকে বিদ্রƒপ করে বলতে শোনা যায়, ওই মানিককা, যে কয়দিন আগে চ্যানেল আইতে এক উপস্থাপককে ইয়ে করছো।
এই বিচারপতি দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের আদালতে ডেকে এনে অপমান-অপদস্থ করার কারণে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ তাকে ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেন। হাইকোর্টের বিচারপতি থাকা কালে তিনি প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের নানা কারণে ডেকে এনে অপমান-অপদস্থ করতেন। তিনি সাবেক নির্বাচন কমিশনার সহুল হোসইন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন সচিব, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদসহ বহু বিশিষ্ট নাগরিককে ডেকে এনে অপমান ও অপদস্থ করেন। বিচারপতি মানিক ট্রাফিক সার্জেন্টদের হাইকোর্টের বিচারকের গাড়িকে সালাম না দেয়ার কারণে আদালতে কান ধরে ওঠবস করিয়েছিলেন।

২০১২ সালের জুন মাসে তৎকালীন জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সমালোচনা করেছিলেন। এরপর বিচারপতি মানিক আদালতে তৎকালীন সংসদের স্পিকার আব্দুল হামিদের (পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি) নজিরবিহীন সমালোচনা করেছিলেন।

এরপর বিচারপতি মানিকের সমালোচনা করা হয় সংসদে। তাকে বিচারপতির পদ থেকে অপসারণের লক্ষ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য তারা প্রধান বিচারপতি এবং প্রেসিডেন্টকে তিন দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। ওই সময় তৎকালীন সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে স্যাডিস্ট হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি মানুষকে অপমান করতে পছন্দ করেন। যারা স্যাডিস্ট, অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়, আমরা তাদের ঘৃণা করি, বলেছিলেন তোফায়েল আহমেদ।

সম্প্রতি ছাত্র বিক্ষোভের সময় বেসকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর একটি টকশোতে গিয়ে বিচারপতি মানিক এক নারী উপস্থাপককে রাজাকারের বাচ্চা বলে সম্বোধন করেন। তার সাথে আক্রমণাত্মক আচরণ করে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন বিচারপতি মানিক। এ বিষয়ের ভিডিও ইন্টারনেট-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

সম্প্রতি বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে সরকারি বাড়িভাড়া পরিশোধ না করার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল করা হয়। তিনি শেখ মুজিব হত্যা মামলার আইনজীবীও ছিলেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তাকে হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সে নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে শাসসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারপতি হিসেবে পুনর্বহাল হন।

বিচারপতি থাকা অবস্থায় শাসসুদ্দিন মানিককে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। যে রায়টি কেন্দ্র করে বিচারপতি মানিক সমালোচনার কেন্দ্রে আসেন সেটি হচ্ছে, কর্নেল তাহের হত্যা মামলার রায়। ওই রায়ে বিচারপতি মানিক কর্নেল তাহেরের বিচারকে ঠাণ্ডা মাথার খুন হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি জিয়াউর রহমানকে ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে বর্ণনা করেন।

২০১৫ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি থাকা অবস্থায় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।

বিচারপতি থাকা অবস্থায় বিমানের বিজনেস ক্ল¬াসে সিট না পাওয়া নিয়ে বিচারপতি মানিক লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছিলেন। ২০১২ সালের শেষের দিকে এই ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার জেরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছিলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।

২০০৩ সালে, বিচারপতি মানিক তার গাড়িকে স্যালুট না করার জন্য ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন।

২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে তাকে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মানিকের বিরুদ্ধে রায়ে স্বাক্ষর না করাসহ ১৪ জন আইনজীবীকে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ করেছিল। বিচারপতি মানিকের আদেশে কারাগারে পাঠানোর পর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর শুক্রবার রাতে তিনি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী ডনা এলাকা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ভারতে যাওয়ার প্রাক্কালে বিজিবির একটি টহল দল সীমান্তে তাকে আটক করে।

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের পাশপাশি ব্রিটেনেরও নাগরিক।
বিচারপতি মানিকের বিষয়ে বিএনপির আইন সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সুপ্রিম কোর্টের একটি কলঙ্কিত নাম। তিনি পলাতক শেখ হাসিনার সরকারের ফ্যাসিস্ট রেজিমের ঘৃণিত প্রতিচ্ছবি। তিনি আওয়ামী লীগ দলের বিশ্বাসী হয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অনেক কটূক্তি করেন। পলাতক শেখ হাসিনা এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের যারা বিরোধিতা করত তাদের প্রত্যেককে নাজেহাল করেছেন। তার থেকে টিভি উপস্থাপিকা পর্যন্ত রেহাই পাননি। এ দেশের মানুষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার চান। যেন অন্য কোনো বিচারপতি মানিকের মতো হতে না পারেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/858318