২৩ আগস্ট ২০২৪, শুক্রবার

পাচারের অর্থ ফেরানোর নামে আইওয়াশ

কর্মকৌশল নির্ধারণে কাজ করে ৪টি কমিটি

অর্থ পাচার রোধ বা পাচারের অর্থ ফেরাতে আওয়ামী লীগ সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। আমলাদের কার্যক্রম বৈঠক-কর্মশালায় আর রাজনীতিকদের বক্তৃতা-ভাষণে সীমাবদ্ধ ছিল। বৈঠকের পর বৈঠক করে আমলারা শুধু করণীয় নির্ধারণ করেছেন, আদতে তা বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। প্রতি বৈঠকে ঘুরেফিরে একই বিষয়ে আলোচনা হতো। আর রাজনীতিকরা স্ববিরোধী বক্তব্য দিতেন। সরকারি দুটি কমিটির গত কয়েক বছরের বৈঠকের কার্যবিবরণী বিশ্লেষণ করে এ চিত্র দেখা গেছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে একটি টাস্কফোর্স ও একটি ওয়ার্কিং কমিটি রয়েছে। ওয়ার্কিং কমিটির প্রধান হচ্ছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব। এ কমিটিতে স্বরাষ্ট্র, পরররাষ্ট্র, দুদক, সিআইডিসহ ২১টি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সদস্য হিসাবে রয়েছে। এ কমিটি ৩ মাস অন্তর বৈঠক করে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স আছে। এটি গঠিত হয় ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর। প্রতি ৩ মাস অন্তর এ টাস্কফোর্সের বৈঠক হয়। এ দুটি কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় সমন্বয় কমিটি অর্থ পাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করে থাকে। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে আরেকটি টাস্কফোর্স রয়েছে, এটি হচ্ছে বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ ফেরত আনার টাস্কফোর্স। এ টাস্কফোর্স ২০১৩ সালের ২৮ মে গঠিত হয়।

ওয়ার্কিং কমিটির কার্যবিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে বিএফআইইউ-এর তৎকালীন প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মো. রাজি হাসানের নেতৃত্বে একটি দলকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে কৌশলপত্র ও গাইডলাইন প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর ১৮তম বৈঠকে কৌশলপত্র উপস্থাপন করা হয়। বিভিন্ন দপ্তরের মতামত নিয়ে এটি চূড়ান্ত করতে তিন বছর সময় পার হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ২৪তম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তী জাতীয় সমন্বয় কমিটির সভায় অর্থমন্ত্রী কৌশলপত্র ও গাইডলাইনটির মোড়ক উন্মোচন করবেন।

একইভাবে ২০২০ সালের বৈঠকে বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, হংকং, থাইল্যান্ড, চীনের সঙ্গে এমএলএ ট্রিটি/অ্যাগ্রিমেন্টের (পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি ও কর তথ্য বিনিময় চুক্তি) বিষয়ে আলোচনা হয়। ২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল ওয়ার্কিং কমিটির ২৪তম সভায়ও সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ২০২০ সালের বৈঠকে সাইবার, পর্নোগ্রাফি, জুয়া ও অনলাইন জুয়া সংক্রান্ত অপরাধকে মানি লন্ডারিং আইনে সম্পৃক্ত অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০২৪ সালের বৈঠকে গ্যাম্বলিং আইন-১৮৬৭ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়।

অন্যদিকে ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ২২তম সভায় সিদ্ধান্ত হয়, মানি লন্ডারিং মামলার ক্ষেত্রে পৃথক প্রসিকিউশন সার্ভিস চালুর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় সমন্বয় কমিটিতে প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। প্রায় দেড় বছর পর ২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল ওয়ার্কিং কমিটির ২৪তম সভায়ও একই বিষয়ে একই সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ অগ্রগতি শূন্য। অবশ্য সব বৈঠকেই মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত ও প্রসিকিউশন বিষয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। একইভাবে টাস্কফোর্সের কার্যবিবরণী ঘেঁটে দেখা যায়, ওয়ার্কিং কমিটি ও টাস্কফোর্সে আলোচনার এজেন্ডা প্রায় একই রকমের। ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত ২১তম সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের তথ্য শেয়ারিংয়ের কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ করা হবে। এক বছর পরও ওই ডেটাবেজ আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ২৩তম সভায় ডেটাবেজের খসড়া পরবর্তী অর্থাৎ ২৪তম সভায় উত্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সকে। এ ধরনের অনেক বিষয়ে বারংবার সিদ্ধান্ত হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি।

রাজনীতিকদের অতিকথন : অর্থ পাচার রোধ এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরানোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার চেয়ে রাজনীতিকরা ব্যস্ত ছিলেন অতিকথনে। ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, কানাডায় টাকা পাচার করে বাড়িঘর বানিয়েছে-এরকম ২৮টি ঘটনা খুঁজে পেয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে রাজনীতিক মাত্র ৪ জন। বাকিরা সরকারি কর্মচারী ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ী।

এর পরের বছর ৭ জুন জাতীয় সংসদে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থ পাচারকারীদের তথ্য চেয়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের মানুষের কষ্টে অর্জিত টাকা বিদেশে চলে যাবে, আপনাদের যেমন লাগে, আমারও লাগে। আমি অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে। আমরা সবাই চাই, এগুলো বন্ধ করতে হবে। আগে সিমেন্টের নামে বালি আসত। এখন আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং আগের মতো হয় না। একদম বন্ধ হয়ে গেছে বলব না।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর শেষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িত ‘স্বনামধন্য’ অনেকের তথ্যই তার কাছে আছে এবং দুদক বিষয়গুলো দেখছে। আসবে, সামনে একদিন আসবে। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এমন অনেকের অর্থ পাচারের তথ্য আছে, ওটা আপনারা লিখবেন কি না, আমার সন্দেহ আছে। অনেক স্বনামধন্যের ব্যাপারেও আমার কাছে (তথ্য) আছে। তদানীন্তন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের এসব বক্তব্য কেবল আইওয়াশ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অদৃশ্য কারণে অর্থ পাচার রোধ কিংবা পাচার অর্থ ফেরানোর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি।

বিশেজ্ঞরা যা বলছেন : পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি ছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অর্থ পাচার রোধ এবং পাচারকৃত টাকা ফেরাতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বৈঠক করে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ফলোআপ করা হয়নি, কোনো উদ্যোগ বা উদ্যম দেখা যায়নি। কারণ, যাদের এসব করার কথা, তারা নিজেরাই ঋণখেলাপি, করখেলাপি বা দুর্নীতিবাজ ছিলেন। সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল। তিনি আরও বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ রাখা ব্যক্তিদের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে অর্থ পাচারকারীদের জবাবদিহির আওতায় এনেছে। আর আমরা শুধু বৈঠক-কর্মশালা করেছি। বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের চুক্তি করতে পারিনি। আইনগতভাবে অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে পারিনি। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিগত সময়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার থাকায় দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহির আওতায় আনার সদিচ্ছায় ঘাটতি ছিল। অর্থ পাচার রোধ বা পাচারকৃত টাকা ফেরাতে কার্যক্রম শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ ছিল, মূল কাজে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। অর্থ পাচারকারীদের তথ্য জানার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ, তারা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, যা সম্প্রতি পত্রপত্রিকার খবরে বেরিয়ে আসছে। তিনি আরও বলেন, অর্থ পাচারকারীরা ক্ষমতার বলয়ে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টরা ভয় পেতেন। আগুনে হাত দিলে পুড়ে যাবে-এ ধরনের মানসিকতা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে তৈরি হয়। প্রকৃতপক্ষে এরাই অর্থ পাচারের সুযোগ করে দিয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/841490