২৩ আগস্ট ২০২৪, শুক্রবার

বৃষ্টিতে ডুবলো চট্টগ্রাম ॥ আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দী

২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১৫৮.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর সেই বৃষ্টিতেই ডুবেছে চট্টগ্রাম শহর। বৃষ্টির পানিতে শহরের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। এতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বুকসমান পানি হয়েছে। সড়কগুলো খালে পরিণত হয়। বাসা-বাড়ি ও দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছে পানি। সড়কে গণপরিবহন চলাচল কমে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন কর্মস্থলগামী মানুষ। ফলে নাগরিক জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ।

নগরীর শুলকবহর, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেইট, মোহাম্মদপুর, জাকির হোসেন রোড, ওয়াসা রেবতী মোহন সড়ক, প্রবর্তক মোড়, কাতালগঞ্জ, ডিসি রোড, ফুলতলা, কে বি আমান আলী রোড, চকবাজার, বাকলিয়া, দেওয়ানহাট, মোগলটুলী, পাঠানটুলী, আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ রোড, হালিশহর ওয়াপদাসহ বিভিন্ন এলাকায় কোমর থেকে বুকসমান পানি হয়।

বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি পাল বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১৫৮.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। আগামী দুইদিন থেমে থেমে বৃষ্টি হবে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হবে ২৪ আগস্ট থেকে।
জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ও কর্ণফুলী নদীতে প্রবল স্রোত থাকায় কালুরঘাটে ফেরি চলাচল দুইদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে সাধারণ লোকজনের গন্তব্যে যাতায়াতে ব্যাপক ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

অপরদিকে ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলা প্লাবিত হতে শুরু করে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি দিকে যাচ্ছে। তিন উপজেলায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে পড়েছে। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে হালদা ও মুহুরী নদীর পানি। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমুন নবী বলেন, চট্টগ্রামে ৯টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। এরমধ্যে ৯৪টি ইউনিয়নে ২ লাখ ১৬ হাজার ৫শ’ মানুষ বন্যা কবলিত। ৫ হাজার ৭১১ জন মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। তিনটি উপজেলা মূলত সরাসরি বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এগুলো হচ্ছে, সীতাকু-, মীরসরাই ও ফটিকছড়ি।

জানা গেছে, ৯ উপজেলায় উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন আড়াই লাখের বেশি মানুষ। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, মীরসরাই ও সীতাকু- উপজেলায় এক লাখ ষাট হাজার মানুষ এ মুহুর্তে পানিবন্দি আছেন। এর মধ্যে ফটিকছড়ি ও মীরসরাইয়ে আক্রান্ত গ্রামের সংখ্যা বেশি। তিন উপজেলায় ১১২টি গ্রাম সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে রাউজান, হাটহাজারী ও বোয়ালখালী উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম।

ফটিকছড়ি উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে আছে। ফসলের ক্ষেত, পুকুর, মাছের খামার তলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফটিকছড়ি থেকে হেঁয়াকো রামগড় সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় খাগড়াছড়ির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

মীরসরাই উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে পানি উঠে গেছে। উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম, হিঙ্গুলী, বারইয়ারহাট পৌরসভা, মীরসরাই পৌরসভা, জোরারগঞ্জ, ধুম, ওচমানপুর, ইছাখালী, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিঠানালা, খৈয়াছড়া, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বারইয়ারহাট-রামগড় সড়ক ও জোরারগঞ্জ-মুহুরী প্রজেক্ট সড়ক প্লাবিত হয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সীতাকু- উপজেলার উত্তরের ছয়টি ইউনিয়ন। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। পানি স্রোতে ভেঙে গেছে উপজেলার বাঁশবাড়ীয়া ইউনিয়নের সিকদার খালের স্লুইসগেট। এতে লোকালয়ে পানি ঢুকে দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।

এছাড়া রাউজান উপজেলার পশ্চিম নোয়াপাড়া, মোকামীপাড়া, সাম মাহালদারপাড়া, ছামিদর কোয়াং, কচুখাইন, দক্ষিণ নোয়াপাড়া, উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম, সওদাগরপাড়া, সুজারপাড়া, পূর্ব উরকিরচর, খলিফার ঘোনা ও বৈইজ্জাখালি, বাগোয়ান, পশ্চিম গুজরা, গহিরা, নোয়াজিশপুর, চিকদাইর, ডাবুয়াসহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে অর্ধলাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। হাটহাজারী উপজেলার বন্যায় প্লাবিত এলাকার মধ্যে রয়েছে বুড়িশ্চর, শিকারপুর, গড়দোয়ারা, দক্ষিণ মাদার্শা, উত্তর মাদার্শা, মেখল, পৌরসভার একাধিক ওয়ার্ড, নাঙ্গলমোড়া, ছিপাতলী।

বোয়ালখালী উপজেলার কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী কয়েকটি গ্রাম, উপজেলা সদর, সারোয়াতলী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় গ্রামীণ সড়ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পুকুর, মাছের খামারও তলিয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন চাষীরা। ফটিকছড়ি উপজেলায় ১৩টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে ৩১৭৫ পরিবার, মীরসরাই উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নে ১২ হাজার পরিবার এবং সীতাকু- উপজেলায় ৬টি উপদ্রুত ইউনিয়নে ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২৯০টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলার ২০০ ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে একটি করে মোট ২০০টি, ১৫ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রত্যেকটিতে পাঁচটি করে মোট ৭৫টি, ৯টি আরবান ডিসপেন্সারির প্রত্যেকটিতে ১টি করে মোট ৯টি, ১টি স্কুল হেলথ ক্লিনিকে ১টি ও জেলা সদর হাসপাতালে (চট্টগ্রাম ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল) পাঁচটি মেডিকেল টিমসহ সর্বমোট ২৯০টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য ওষুধ, স্যালাইন, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুদ আছে। মেডিকেল টিমগুলো ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করেছে।

চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ করা হয়েছে। বন্যায় ফেনীতে রেললাইন ও রেল সেতুর ওপর দিয়েও পানি প্রবাহিত হচ্ছে। একই অবস্থা সিলেটের একটি রেলসেতুরও। চট্টগ্রাম-ক্সবাজার রেললাইনে পাহাড় ধস হয়েছে। এসব কারণে চট্টগ্রামের সব ট্রেন চলাচল বন্ধ রেখেছে রেলওয়ে।

রেল পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, রেললাইনে পানি ওঠা ও পাহাড় ধসের প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তা এবং রেলের সম্পদ রক্ষায় ট্রেন চলাচল আপাতত বন্ধ থাকবে। তিনি জানান, চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস এবং সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ছেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বন্যার কারণে ট্রেনগুলো গন্তব্যে যেতে পারেননি।

রেলওয়ের কন্ট্রোল বিভাগ জানায়, ফেনী থেকে ফাজিলপুর পর্যন্ত রেললাইন পানিতে ডুবে গেছে। সিলেট রুটের কয়েকটি জায়গায়ও পানি উঠেছে। বন্যার পানিতে কুমিল্লায় রেললাইন উপড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফেনী স্টেশনে বন্যার পানি জমে রয়েছে। কক্সবাজার রুটের পাহাড় ধসও হয়েছে। এসব কারণে গতকাল দুপুরের পর থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচলরত আন্তনগরসহ সব ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

https://www.dailysangram.com/post/564537