উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারী বৃষ্টির পানির প্রভাবে দেশের ১০ জেলায় প্রায় ৩৬ লাখ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এলাকাগুলোতে রীতিমত মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালের এক তথ্য বিবরণীতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই বন্যায় বিকাল পর্যন্ত ১০ জেলায় এসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে বন্যার পানিতে ডুবে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় একজন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়। তবে বেসরকারী হিসেবে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি বলে জানা গেছে।
গত ২০ আগস্ট থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, এখন পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১০। সেগুলো হলো, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট ও লক্ষ্মীপুর। এসব জেলার ৬৫ উপজেলা বন্যায় প্লাবিত। এই ১০ জেলায় মোট ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৪০টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
পানিবন্দী ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দিতে মোট এক হাজার ৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় মোট ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন ও সাত হাজার ৪৫৯টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আট জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৪৪৪টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীসমূহের সংলগ্ন নি¤œাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তীতে উন্নতি হতে পারে।
আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা ইত্যাদি নদীসমূহের সংলগ্ন নি¤œাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তীতে উন্নতি হতে পারে।
বন্যায় চার জেলায় ৮ জনের মৃত্যু
এদিকে আকম্মিক বন্যায় চার জেলায় আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। চলমান বন্যায় কুমিল্লায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে দুজন বন্যার পানিতে তলিয়ে, একজন বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং একজন মাথায় গাছ পড়ে মারা গেছেন। মৃতরা হলেন- নাঙ্গলকোট পৌরসভার দাউদপুর এলাকার কেরামত আলী (৪৫), কুমিল্লা শহরের ছোট এলাকার কিশোর রাফি (১৫), চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সোনাকাটিয়া গ্রামের কানু মিয়ার ছেলে শাহাদাত হোসেন (৩৪) এবং লাকসামে পানিতে তলিয়ে মারা যাওয়া শিশুর নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
টানা কয়েক দিনের বৃষ্টি ও উজানের ঢলে কক্সবাজারে দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে অন্তত ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এসব এলাকার আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া পানিতে ভেসে গিয়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) তাদের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- রামু উপজেলার সাচিং মারমা (২৬) ও আমজাদ হোছন (২২)। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে একজন মারা গেছেন। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার পানিতে ডুবে সুবর্ণা আক্তার নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার দুপুর ২টার দিকে উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরচন্দ্রপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। সুর্বণা আক্তার বীরচন্দ্রপুর গ্রামের পারভেজ মিয়ার স্ত্রী।
চট্টগ্রামের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ
ফেনী ও কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে রেললাইন পানিতে ডুবে গেছে। এছাড়া রেল সেতুর ওপর দিয়েও পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে দুটি ট্রেন ছেড়ে গেলেও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দুপুরের পর থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচলরত আন্তঃনগরসহ সব ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস এবং সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ছেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বন্যার কারণে ট্রেনগুলো গন্তব্যে যেতে পারেনি। ফেনী থেকে ফাজিলপুর পর্যন্ত রেললাইন পানিতে ডুবে গেছে। বন্যার পানিতে কুমিল্লায় রেললাইন উপড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফেনী স্টেশনে বন্যার পানি জমে রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, জামালপুর, সিলেট ও চাঁদপুরে প্রতিদিন ১১টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এ ছাড়া কক্সবাজার, নাজিরহাট, চাঁদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহে লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চলাচল করে নিয়মিত।
রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ফেনীতে রেললাইন ও রেলসেতুর ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। একই অবস্থা হয়েছে সিলেটের একটি রেল সেতুতেও। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনেও পাহাড় ধস হয়েছে। এ অবস্থায় ট্রেন চালানো খুবই বিপজ্জনক। তাই যাত্রীদের নিরাপত্তা এবং রেলের সম্পদ রক্ষায় ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ট্রেন চলাচলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্যার কারণে ফেনী ও কুমিল্লায় রেললাইন ডুবে গেছে।
উপদেষ্টারা যাবেন বন্যা কবলিত এলাকায়
দেশের বন্যা পরিস্থিতির জন্য প্রতিবেশি দেশকে দায়ী করলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, উজানের পানি বাংলাদেশে ধেয়ে এসে এই বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করছে। কোনও ধরনের আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই এই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশের মানুষ-শিক্ষার্থী এবং জনগণ ভারতের নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ এমন মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য আন্দোলন করছে। কথা বলে আসছে। আমরা আশা করব, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ভেতরে কোনও টানাপড়েন যাতে না রাখা হয় এবং একটি ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক প্রতিস্থাপন করা হয়।’ ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আহ্বান করবো, আশা করবো, ভারত বাংলাদেশের জনগণবিরোধী এ ধরনের নীতি থেকে সরে আসবে। আমরা কীভাবে দুই দেশের জনগণকে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে পারি, সে বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধানের পথ বের করতে হবে।’
নাহিদ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে জাতি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, একইভাবে দেশের সব সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতি আহ্বান জানাই, যাতে সবাই সম্মিলিতভাবে এই বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারি। দেশের মানুষকে রক্ষা করতে পারি। আমরা সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানাবো, তারা যেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগিয়ে আসেন। সরকারকে সহযেগিতা করেন।’
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বন্যা উপদ্রুত সবগুলো জেলাতে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা যাবেন। ত্রাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আজই সেখানে যাচ্ছেন। তিনি যতটা বন্যার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব, সেখানে গিয়ে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয় করবেন। আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও একটা সমন্বয় করার উদ্যোগ নিয়েছি।
বন্যার কারণ উল্লেখ করে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা শুনেছি, উজানে অনেক বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতেও অনেক বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ ধরনের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী ধরনের আগাম সতর্কতা আমরা পেতে পারি, আমাদের আগাম সতর্ক করা হয়েছিল কিনা? ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে রাষ্ট্রগুলো কীভাবে কাজ করতে পারে, সুনির্দিষ্ট কী পদক্ষেপ নিতে পারে, সে বিষয়ে কথা বলতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনারের মধ্যে এখন একটি বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে জানতে চাওয়া হবে বন্যার কারণটা। এটা ভবিষ্যতে এড়িয়ে চলতে আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামো ও আমাদের সম্পাদিত চুক্তিগুলো মেনে বা আরও কোনও চুক্তি করতে হলে, সেটা করে এই পরিস্থিতি কীভাবে এড়িয়ে চলতে পারি সেই বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। কাজেই এটা অবশ্যই অফিসিয়াল চ্যানেলে জানানো হচ্ছে। এখানে একটি বিষয় হচ্ছে, দেশের একটা বাস্তবতা থাকে। মানুষের একটা ভাষা থাকে। সেই বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ অলরেডি কথা বলেছেন।’
যতক্ষণ পর্যন্ত বন্যা উপদ্রুত সব মানুষের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে তাদের পুনর্বাসনের পূর্ণ ব্যবস্থা না হবে, ততক্ষণ আমাদের নজরদারিতে থাকবে বলে জানান সৈয়দা হাসান।