৫ আগস্ট ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মাধ্যমে গণবিপ্লব সাধিত হয় এবং ঐদিন বেলা ৩টায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে ভারতের উদ্দেশে পলায়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার। এ সরকারের আইন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুলের বুদ্ধিমত্তায় শেখ হাসিনার করা আইনেই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এ যাবত প্রায় ১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং প্রথম মামলাটির তদন্তও চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে- উল্লেখিত আইনটি করা হয় ১৯৭৩ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। প্রশ্ন হলো শেখ হাসিনা কি দেশের স্বাধীনতার পক্ষে বা বিপক্ষে কোন যুদ্ধ করেছেন? নিঃসন্দেহে তিনি তা করেননি। তাহলে কোন যুক্তিতে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ আইনে বিচার করা হবে? এ প্রবন্ধে এ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হবে। দ্বিতীয়ত ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার দালাল আইন ১৯৭২ প্রণয়ন করেন এবং সে আইনে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনকারী অভিযুক্তদের বিচারও করেন এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন ১৯৭৩ সালের ১ ডিসেম্বর। এর ফলে ৩৬৪০০ বন্দীও মুক্তি পেয়ে যায়। এ দিকে দিল্লী চুক্তি ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ১৯৭ পাকিস্তানী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাসহ আটককৃত ৯৩ হাজার পাকিস্তানী ভারতীয় জেলে বন্দী সৈনিকদেরও ক্ষমা করে দিয়ে তাদের পাকিস্তান চলে যাওয়ার পথ খোলা করে দেয়া হয়। দালাল আইনে প্রায় ১ লাখের বেশী লোককে বন্দী করা হয়। বিচারের আওতায় আনার জন্য ৩৭৪৭১ জনকে শনাক্ত করে তদন্ত করা হয়। এর থেকে ২৮৮৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয় আর বাকী ৩৪৫৮৭ জন অপরাধমুক্ত হন। চার্জশিটকৃত ২৮৮৪ জন থেকে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়। এর মধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- দেয়া হলেও একজনের বিরুদ্ধেও মৃত্যুদ- কার্যকর হয়নি। কারণ ৪ জন অনুপস্থিত, একজন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের চিকন আলী। তার মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে আপিল করলে সুপ্রীম কোর্ট মৃত্যুদ- রহিত করে তাকে যাবতজীবন কারাদ- দেয়া হয়। প্রশ্ন হলো : এতকিছুর পরও যুদ্ধাপরাধী থাকে কোথায়? হ্যাঁ- নেই তবে শেখ হাসিনা ২য় মেয়াদে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধন করে কথিত যুদ্ধাপরাধী তৈরি করে তাদের বিচারও করেছেন। তাদের ধারণায় ও বিশ^াসে যুদ্ধাপরাধী বা মানবতা বিরোধীদের অস্তিত্ব বিলীন হয়েগেছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যে আইনে নিজামী-মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হলো সেই একই আইনের একই ধারায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলো! একেই বলে ‘যে অসৎ উদ্দেশ্যে গর্ত খোঁড়ে সেই গর্তে তাকেই পড়তে হয়।’ অতএব, যে আইনে শেখ হাসিনা অভিযুক্ত সে আইনের খুঁটি-নাটি বিষয় সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচিত হবে এ প্রতিবেদনটিতে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইন্যুনাল) ১৯৭৩ অধ্যাদেশ আইন নং XIX (১৯) প্রেক্ষিত : ধারা নং ৩ এবং ৪. (International Crime (Tribunel) Act, 1973) : আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধসমূহকে সমন্বিত করে এ ট্রাইব্যুনালটি প্রণীত হয়েছে বলেই এর নাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাখা হয়েছে। এটি ১৯৭৩ সালে প্রণীত হয়। পুনরায় শেখ হাসিনা ২য় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ তা সংশোধীত আকারে (Amended version) প্রকাশিত হয়। এতে রয়েছে ২৬টি ধারা। ধারা নং ৩ এবং ৪ এর অধীনে জামায়াতের নেতৃস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং সালাহ উদ্দীন কাদেরেরও বিচার করা হয় এবং ফাঁসি কার্যকর করা হয়। একই ধারায় শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীরা আজ অভিযুক্ত। ১৪ আগস্ট সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী গাজী এইচ এম তামীম প্রথম অভিযোগটি দায়ের করেন ট্রাইব্যুনালের উপ-পরিচালক আতাউর রহমানের দফতরে যা নথিভুক্ত হয় এবং প্রধান প্রসিকিউটরের নিকট পেশ করা হয়। তদন্ত হবে চলমান গণহত্যা আইনের মানদ-ে।
উল্লেখ্য, সংশোধনীর পূর্বে উক্ত ধারাটির বর্ণনা ছিল : আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী এবং অন্যান্য অপরাধের জন্য ‘ব্যক্তিদের (Persons)’ আটক, বিচার ও শাস্তি প্রদানের জন্য মূলত এ আইনটি প্রণীত হয়। ২০০৯ সালের সংশোধনিতে ব্যক্তিদের স্থলে ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গ (Individual and group of Individual) শব্দদ্বয় সংযুক্ত করা হয়। এই পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে বেসামরিক নাগরিকদেরও এ আইনের অধীনে নিয়ে আসা হয়। শেখ হাসিনা এবং তার অপকর্মের সহযোগীদেরও (Accomplies) এ পরিবর্তিত শব্দদ্বয়ের নিমিত্তেই অভিযুক্ত করা হয় (Accused). অতএব, সংশোধীত পূর্ব অবস্থার আইনে উপশম পাওয়ার তাদের আর কোন সুযোগই থাকলো না।
৩নং ধারাটি হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার বিষয়ক : ৩(১) ধারা বলে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গোষ্ঠী অথবা সংগঠন অথবা সশস্ত্র সদস্যদের বিচার ও শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকবে এ ট্রাইব্যুনালের এমন সব অপরাধ যারা এ আইন প্রবর্তনের পূর্বে ও পরে করেছে। ৩(২) ধারাটি মানবতা বিরোধী অপরাধের ধরন বিষয়ক। যেমন-৩(২)(ক) (Crime against humanity) মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ : এ আইনে অপরাধের প্রকারভেদসমূহ হচ্ছে : হত্যা, নির্মূল, দাসত্ব, নির্বাসন, কারাবরণ, অপহরণ, বন্দীকরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ অথবা যে কোন বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অমানবিক কাজ (Inhuman act) অথবা রাজনৈতিক, জাতিগত, জাতি বা ধর্মীয় কারণে নিপীড়ন করা তা আইন করে হোক অথবা আইন বহির্ভূতভাবেই হোক।
৩(২)খ(শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ) : (Crime against Peace)-এর অন্তর্ভুক্ত অপরাধসমূহ হলো পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রস্তুতি গ্রহণ এবং অপরাধ সংঘটনের সূচনাকরণ যা আন্ত ও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে সম্পাদিত চুক্তি লংঘন করে বা চুক্তি করার আশ্বাস ভঙ্গ করে সম্পাদন করা হয়ে থাকে।
৩(২)গ (গণহত্যা Genoside) : গণহত্যাজনিত অপরাধসমূহের যে কোন একটি ভঙ্গ করলেও তা গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হবে। কোন একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক দলকে আংশিকভাবে বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস বা নির্র্মূল করার লক্ষ্যে নিম্ন বর্ণিত কাজগুলো গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হবে। কাজগুলো : ঐ দলের সদস্যদের হত্যা করা (আইন করে বা আইন বহির্ভূতভাবে) ইচ্ছাকৃতভাবে ঐ গ্রুপের সদস্যদের শারীরিক বা মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে ঐ গ্রুপের উপর এমন শর্ত আরোপ করা বা চাপ প্রয়োগ করা যাতে ধীরে ধীরে তা নির্মূল হয়ে যায়। তাদের জন্মরোধ ও জন্ম বিস্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, তাদের সন্তানদের জোর করে অন্য গ্রুপে বা স্থানে স্থানান্তর করা।
৩(২) (ঘ) যুদ্ধাপরাধ (War Crime) : যুদ্ধ বিষয়ক অপরাধসমূহ হচ্ছে- আইন বা যুদ্ধনীতি ভঙ্গ করে দেশের বেসামরিক জনগণকে হত্যা করা, দুর্ব্যবহার করা, দাসসম শ্রমে নিয়োগ করা, আশ্রয়ে থাকা লোকদের হত্যা করা, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানা সম্পত্তি লুণ্ঠন করা, শহর নগর গ্রাম ধ্বংস করা, ন্যায়সংগত নয় এমন কাজে সৈনিকদের দিয়ে ন্যায়ভ্রষ্ট কাজ করা।
৩(২)(ঙ) ১৯৪৯ সালে সম্পাদিত জেনেভা কনভেনশনে নির্ধারিত সংঘাতে প্রযোজ্য কোনো মানবিক নিয়ম ভঙ্গ করা। আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্য যে কোনো আইন ভঙ্গ করা, এ জাতীয় কাজ করার প্ররোচনা, চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করা এবং এ জাতীয় অপকর্ম সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা। এসবই যুদ্ধপরাধের শামিল। এ ধারায় উল্লেখিত বিষয়গুলো স্ব-ব্যাখ্যামূলক (Self-explanatory), সবগুলো ধারা এমনকি ৩(২)(ঘ) ধারার যুদ্ধাপরাধ বিষয়গুলো শেখ হাসিনা এবং তার কুকর্মের সাথীদের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ এবং স্থান বিশেষে পরোক্ষভাবে জড়িত।
ধারা-৪ অপরাধের দায়বদ্ধতা (Liability of crime) : এ ধরায় মূলত অপরাধ সংঘটনের ধরন বিষয়ে আলোচিত হয়েছে। যেমন ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে; ৩নং ধারায় বর্ণিত যেকোনো অপরাধ যখন একাধিক ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত হয় তখন প্রত্যেক ব্যক্তি এককভাবে সেই অপরাধের জন্য এককভাবে দায়বদ্ধ যেন ঐকাজটি এককভাবে তার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।
৪(২) ধারা অনুযায়ী সে ব্যক্তিও এককভাবে দায়ী যিনি ৩(১) ধারায় বর্ণিত যে কোনো অপরাধের আদেশ দেন, অনুমতি দেন, স্বীকার করেন বা অংশগ্রহণ করেন বা অংশগ্রহণের আদেশ দেন, অপরাধ সংঘটনের কোনো পরিকল্পনা বা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকেন বা যিনি অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন বা অর্পিত দায়িত্বে বা কর্মে বিরত থাকেন বা ইস্তেফা দেন। তিনিও একই অপরাধে অপরাধী যিনি তার অধীনস্তদের শৃঙ্খলা বজায় রাখা বা তাদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ বা তত্ত্বাবধানে দায়িত্বের অবহেলা করেন বা তাদের অপরাধ প্রতিরোধে ব্যর্থ হন।
অতএব, এ ধারায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতার আলোচনায় স্বভাবতই প্রশ্ন আসে কে সেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এতে প্রথম নম্বরে যার। আসবে তিনি হলেন সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান- অতঃপর প্রতিটি বিভাগের প্রধানই, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের প্রধান উপদেষ্টা, প্রতিরক্ষা বিভাগ (Defense) এবং বিদ্যুৎ বিভাগেরও প্রধান। সাধারণভাবে সকল বিভাগ আর বিশেষভাবে প্রতিরক্ষা, বিদ্যুৎ এবং ছাত্রলীগ কর্তৃক সংঘটিত সকল অঘটনের জন্য শেখ হাসিনা ৪ ধারায় বর্ণিত অঘটনের জন্য দায়বদ্ধ হতে বাধ্য। (As per Concept of Superior order)
ট্রাইব্যুনালটি একটি কালো আইন (It is as a black law): ২৬ ধারা মতে এ আইনের অনেকগুলো ধারা প্রচলিত আইনের সাথে চরম সাংঘর্ষিক। এটি করা হয়েছে শেখ হাসিনার বিপক্ষ শক্তিকে নির্মূল করার লক্ষ্য যাতে অভিযুক্তগণ ঐ আইনের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারেন। যেহেতু আইনটি বলবৎ অতএব, আশার কথা হচ্ছে, চলমান প্রক্রিয়ায় এ আইনের আওতায় শেখ হাসিনাসহ কোনো অভিযুক্ত (Accused) ব্যক্তিও এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। অসঙ্গতির কয়েকটি উদাহরণ হলো : ১৯নং ধারায় বলা হয়েছে : এ ট্রাইব্যুনালটি প্রযুক্তিগত কোনো নিয়ম দ্বারা আবদ্ধ নয় (Technical procedure) বরং এটি সম্ভাব্য ত্বরিৎ এবং অপ্রযুক্তিগত পদ্ধতি অবলম্বন এবং প্রয়োগ করবে (Non-technical procedure), এজন্য সংবাদ, সাময়িকী এবং ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন, ফটোগ্রাফার, চলচ্চিত্র এবং রেকর্ডিং এবং অপরাপর উপকরণসহ যে কোনো তথ্যকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করবে (It seems to have probative value). এতে আরো বলা হয়েছে, কোনো একটি ঘটনা-যেমন সাক্ষীর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের জন্য সাধারণ জ্ঞানের আলোকে গৃহীত প্রমাণের কোনোই প্রয়োজন মনে করে না এ আদালত বরং উক্ত তথ্যকে বিচার বিভাগীয় নোটিশ হিসেবে মনে করে। (Shall not require proof of facts of common knowledge, but shall take judicial notice thereof).
২২নং ধারামতে এই আদালত তার নিজস্ব কার্যপদ্ধতি মতে চলবে এবং ২৩ নং ধারামতে ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এবং সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এ আদালতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। ২৪ নং ধারা মতে আদালতের কোনো বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। হোক না তা কার্যবিধি বা শাস্তির ধরন এবং এর সাথে সম্পৃক্ত কোনো বিষয়ে কোনো আদালতে মামলাও করা যাবে না। ২৬ নং ধারায় আরও প্রত্যয়ের সাথে বলা হয়েছে যে, চলমান যেকোনো আইনের সাথে এ আইনের কোনো অংশ যদিও সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে তথাপী এ আইনে বর্ণিত বিধানই হবে গ্রহণযোগ্য এবং প্রভাবশালী আইন। এর অর্থ-দেশে প্রচলিত সকল আইনের উপর সবচেয়ে বড়, শক্তিশালী এবং গ্রহণযোগ্য আইনই হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি এবং দেশের সবচেয়ে বড় আইন, সাংবিধানিক আইনও বরং এ আইনের অধীনে। আশার কথা হচ্ছে, সবচেয়ে বড় এ আইনটিতেই অভিযুক্ত এ আইনের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্রষ্টা হযরত শেখ হাসিনা এবং তার অসৎ সহচরেরা। তারই তৈরি আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার অধিকারও তার থাকছে না দেশ-বিদেশের কোন আদালতে যেমন করতে পারেননি নিযামী-মুজাহীদের।
রাষ্ট্রীয় সংবিধানের চেয়েও আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক আইনটি অনেক বড় যা মৌলিক মানবাধিকারকেও রহিত করতে পারে। যেমন বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৭ক(১) অধ্যায়ে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে যারা অভিযুক্ত হবেন তারা সংবিধানের ৩১(১)(৩), ৩৫ এবং ৪৪ এ প্রদত্ত মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবেন। ৩১(১)(৩) এ আইনে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার, ৩৫ এ বিচার এবং শাস্তির সুরক্ষা এবং ৪৪ এ মৌলিক অধিকার সুরক্ষার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হবেন। স্মরণীয় বিষয় হচ্ছে, শেখ হাসিনাসহ যারা চলমান উল্লেখিত ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত হলেন তাদের ক্ষেত্রে সুরক্ষা বিষয়ক অনুচ্ছেদগুলোও প্রযোজ্য। ইতোমধ্যেই শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে অবৈধ ঘোষণার জন্য আদালতে আবেদনও করেছেন সারডা নামের একটি মানবতাধিকার সংগঠন। জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে নির্বাহী আদেশ সন্ত্রাস দমন আইনের ১৯ নং ধারা মতে। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৩(১) ধারা মতে আইনগতভাবে আওয়ামী লীগকেও বেআইনি ঘোষণা করা যেতে পারে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫ম সংশোধনীর ধর্মীয় দর্শন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়গুলো বাতিল করে ১৯৭২ সালে প্রণীত সেক্যুলার দর্শনগুলো পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। এতে ধর্মীয় বিশ^াসীদের নির্মূলের একটা পরিকল্পনা ছিল এবং হয়েছেও তাই। অতএব, অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ ধারা মতেও শেখ হাসিনা এবং তাদের পাপকর্মের সঙ্গীদের বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে।
পরিশেষে যে কথাগুলো গুরুত্বের সাথে স্মরণীয় তাহলো : তাদের ভাষায় ৩০ লাখ লোক শহীদ হলো, আড়াই লাখ নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হলো আর সারা দেশে ৮০টি ট্রাইব্যুনাল করে বিচারও হলো, মাত্র ২৮৮৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া হলো, ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলো, শাস্তিও পেল এর মধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- ঘোষণা হলো অথচ উইকিপিডিয়ার বর্ণনা মতে, কারোরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা হলো না, হয় পলাতক থাকার কারণে, অথবা দ- হ্রাস করার কারণে। পর্বতের মূষিক (ইঁদুরের বাচ্চা) প্রসবও হলোÑ সেই দালাল আইন রহিত হলো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা হলো, ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে, যুদ্ধাপরাধের বিচার না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, সকল পাকিস্তানী সৈনিক ও নাগরিকদের নিঃশর্তে ভারতীয় বন্দিশালা থেকে ছেড়ে দেয়া হলো। আর কী বাকি থাকলো? হ্যাঁ বাকি ছিল হাসিনার দর্শনে তার প্রতিপক্ষ প্রধান ইসলামী নেতৃত্ব এবং ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এদের চিরতরে নির্মূল করার জন্য তার প্রতিবেশী বন্ধুদের (সম্ভবত) নির্দেশনায় নবরূপে সাজানো হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩কে। এতে চবৎংড়হ-এর পরিবর্তে Individual or group of individual দর্শনকে যোগ করে যোদ্ধারা বা যোদ্ধাদের সহযোগীকে বাদ দিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রলেপে মূলত: যুদ্ধ অপরাধের জন্য করা আইনের অধীনে বিচার মঞ্চস্থ করা হলো-মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহীদ এবং জামায়তের ঊর্ধতন নেতৃস্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ অনেক বেসামরিক নাগরিকদের। আল্লাহ তায়ালা নিপুণ পরিকল্পনার আলোকে এ মানবতা বিরোধী আইনের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ হাসিনার পতন হয়েছে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তার করা আইনেই আজ তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। এ জন্যই বলা হয়, আল্লাহ তায়ালা ছাড় দেন ছেড়ে দেন না। এ শিক্ষা শুধু শেখ হাসিনার জন্য বরং শেখ হাসিনার সমকর্মের সকল সংগঠকদের জন্যই এ বার্তা সমানভাবে কাডর্যকর হলো এবং হতে বাধ্য।