১৮ আগস্ট ২০২৪, রবিবার

পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তা হত্যার জন্য দায়ী শেখ হাসিনা

সংবাদ সম্মেলনে শহীদ পরিবারের দাবি

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা বিদেশী একটি রাষ্ট্রের সাথে ষড়যন্ত্র করে দেশের ৫৭ জন সেনা অফিসার ও ১৭ জন সিভিলিয়ানকে হত্যা করেছে। যার প্রকৃত তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়েছেন বিডিআর’র তৎকালীন মহাপরিচালক নিহত মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া ও অন্যরা। তারা বলছেন নানা চাপের কারণে গত ১৫ বছর মুখ খুলতে পারেননি। এখন আর কোনো নাটক নয়, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ট্রায়াল দাবি করেছেন তারা।
গতকাল শনিবার দুপুরে মহাখালী রাওয়া ক্লাবের স্কাইলাইন রেস্টুরেন্টে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন। শহীদের স্বজনরা বলেন, ১৫ বছর ধরে একটাই আমাদের দাবি ‘বিচার চাই।’ এ বিষয়ে আর লুকোচুরি চাই না। চাপ দিয়ে মুখ বন্ধ করা ছিল। বাধার মধ্যে ১৬ বছর পার করেছি।

রাকিন বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলুল করিম সেলিম। শাকিল আহমেদের ছেলে বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই- যেখানে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) অন্য একটা বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে ষড়যন্ত্র করে রাজধানীতে ৫৭ সেনা অফিসারকে হত্যা করে। আমি নাটক সাজানোর নামে রহস্যশালা আর চাই না। গত ১৫ বছরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারের ট্রায়াল বা তদন্তকে আমরা মানি না। কারণ প্রধান যিনি হত্যাকারী, নির্দেশদাতা তিনি তখন ক্ষমতায় ছিলেন। খুনি কী তার নিজের বিচার করবে? মুখ বন্ধ করে দেখতে হয়েছে, কেমন করে তদন্ত, ট্রায়াল প্রভাবিত করল, ডাল ভাতের কথা বলল। নীরবতায় সহ্য করতে হয়েছে।

ওই দিনটিকে আমরা শহীদ সেনা দিবস দাবি করছি। তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের কথা বলতে গেলে অনেক কথাই গুছিয়ে বলা কঠিন হয়ে যায়। আমার বাবা সবসময় বলতেন, মানুষের স্বার্থ আগে দেখতে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর দেশপ্রেমিক অনেক সেনা অফিসার বিচার চাইতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছেন। কেউ কেউ জেলে গেছেন। দরবারের শত শত অফিসারের জীবন ধ্বংস করা হয়েছে। আমরা সেসব দেশপ্রেমিক অফিসারের অবদান ভুলব না। এক আওয়ামী লীগ নেতা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন- ওনার নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমার বাবা-মাকে জবাই দিয়েছেন। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি তাহলে বাবা-মার মতো আমাকেও জবাই দিয়ে দেবে।

আমরা দাবি করছি, তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। আমরা চাই নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা হোক। ক্ষতিগ্রস্ত সেনা অফিসারদের পরিবারকে যেন যথাযথ সম্মান ও ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। আমরা শহীদ পরিবার মনে করি- যেসব নির্দোষ, দেশপ্রেমিক বিডিআর সৈনিক জেল খাটছেন, সুষ্ঠু তদন্তে যেন তাদের মুক্তি দেয়া হয়। রাকিন আহমেদ বলেন, আপনারা সাংবাদিকরাও কম নির্যাতনের শিকার হননি। অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারতেন না।

সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী এগিয়ে যায়। তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি না করে এগিয়ে এসেছেন। জনগণকে অনুরোধ করব, সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করুন।

বাহিনীর পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের সাবেক মহাপরিচালক লেফট্যানেন্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর। যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আমরা চাইব অন্তত তার কমিটির রিপোর্টটা পাব। উচ্চ আদালত যে তদন্ত কমিশনের কথা বলেছেন, সেগুলো যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে পর্দার আড়ালে যারা ষড়যন্ত্রকারী তারা বেরিয়ে আসবে।
তারা ৫৭ অফিসার ও ১৭ সাধারণ নাগরিকের পরিবারের পক্ষ থেকে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন। যার মধ্যে রয়েছে ১. পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সত্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে পূর্বে যেসব তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তের রিপোর্ট পাবলিক করতে হবে। ২. হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় মোতাবেক তিনজন জজ যে তদন্ত কমিশনের কথা বলেছেন, অবিলম্বে সেই তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। এতে পর্দার আড়ালে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে। ৩. অফিসিয়াল গ্যাজেট করে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। গ্যাজেটে শাহাদাত বরণকারী সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। ৪. ২৫ ফেব্রুয়ারি শোক দিবসকে ঘিরে গোটা দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে। ৫. পিলখানা ট্রাজেডিকে স্কুলের পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে, কি ছিল এসব শহীদের ত্যাগ। ৫. যেসব সেনা কর্মকর্তা এ ঘটনাকে ঘিরে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা যথাযথ কম্পেন্সেশন প্রদান করতে হবে। ৭. নির্দোষ কোনো বিডিআর সদস্যকে যেন কোনোভাবেই সাজা না দেয়া হয়।
শহীদ কর্নেল কুদরত ইলাহীর স্ত্রী লবী রহমান বলেন, হয়তো বলবেন, এতদিন পর কেন আমরা এখানে। অনেক কিছুই তো পেয়েছি। কিন্তু গত ১৫ বছরে আমরা কিন্তু শুধু বিচারই চেয়েছি। প্রথমেই আমাদের প্রশ্ন করা হয়, কি কি পেয়েছি। ইচ্ছে হয় সব ফেরত দেই, আমার স্বামী শহীদ কর্নেল কুদরত ইলাহীকে ফিরিয়ে দেন। এটা সিনেমা বা নাটকের প্রমোশন না, এটা খুবই সেনসিটিভ। শহীদ মেজর মোসাদ্দেকের মেয়ে নাজিয়া বলেন, আমরা তো আমাদের স্বজনদের হারিয়ে ফেলেছি। মানুষ আসলে জানুক এ হত্যাকাণ্ড কারা করেছে। কেনও এত বছর পরও আমাদের মুভমেন্টে বাধা হয়। কর্নেল নাহিদের মেয়ে নাবিলা বলেন, এটা একটি আন্তর্জাতিক চক্রের কাজ। আন্তর্জাতিক শক্তি দ্বারাই এ কাজটি করেছে। আপনারা বের করবেন আসলে কারণটা কি। এটা বিদ্রোহ নাকি হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, আমার বাবা মারা যাননি। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিছু অপপ্রচারের জন্য আমরা হেনস্তা হয়েছি। আজকে আমরা নির্ভয়ে কথা বলছি।

এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট সাকিব বলেন, দুটো তদন্ত কমিটি হয়েছিল। বাহিনীর পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের সাবেক মহাপরিচালক লেফট্যানেন্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর। যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আমরা খুব করে চাইব অন্তত তার তদন্ত কমিটির রিপোর্টটা পাব। কারণ আমরা খুব কাটছাঁট অংশ গণমাধ্যমে জেনেছি। আমরা পুরোটাই দেখতে চাই। তাতে আমরা অনেক কিছু জানতে পারব। আর উচ্চ আদালত যে তদন্ত কমিশনের কথা বলেছেন, সেগুলো যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে পর্দার আড়ালে যারা ষড়যন্ত্রকারী তারা বেরিয়ে আসবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা চার্জ করতে পারব।

গত ১৫ বছর যারা ক্ষমতায় ছিলেন পিলখানা হত্যাকাণ্ডে তাদের দায়ী করছেন কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন আইনজীবী হিসেবে আমি তো সরাসরি দায়ী করতে পারি না। আমরা তো অনেক নাম শুনি। আপনারাও শোনেন। কিন্তু সেই নামগুলো আমরা তখনই বলতে পারব যদি তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে।

পিলখানা সত্য উদঘাটন তো হয়নি। সত্য উদঘাটনের পর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করবে কারা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই এটার দায়িত্ব সরকারের। এ মুহূর্তে হয়তো পর্দার আড়ালে ষড়যন্ত্রকারীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারব না, কিন্তু আপাতত ঘটনাটা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যখন ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বের হবে তখন তা যুক্ত করা হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/856517