স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ১৫ বছরের দুঃশাসনে সবচেয়ে বড় লুটপাট হয়েছে দেশের আর্থিক খাতে। ব্যাংক উদ্যোক্তা ও রাঘববোয়াল কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। সেই টাকা আর পরিশোধ করছেন না। এমনকি বছর শেষে মুনাফাও পরিশোধ করছেন না। আবার পরস্পরের যোগসাজশ করে পরিচালকরা এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের ঋণ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। এসব ঋণও পরিশোধ না করে যোগসাজশের ভিত্তিতে বছরের পর বছর নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এভাবে ব্যাংকের কিছু উদ্যোক্তা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। তারা ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ না করায় কিছু ব্যাংকের মূলধন কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না কিছু ব্যাংক। আর ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থাতো আরো নাজুক অবস্থায় চলে এসেছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে বেসিক ব্যাংক থেকে আব্দুল হাই বাচ্চু, আর্থিক প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স (হালে আভিভা) ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি পি কে হালদারসহ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব অর্থ ফেরত আনতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে; অন্যথায় আর্থিক খাতের অস্থিরতা কমবে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এ বিষয়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আখতার হোসাইন সান্নামাত এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এর আগে ঋণখেলাপিদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তা যথার্থ ও পরিপূর্ণ নয়। বছরের পর বছর যারা বিশেষ বিবেচনায়, কিংবা বিশেষ সুবিধায় ঋণ নবায়ন করে এ তালিকার বাইরে আছেন তাদের নাম প্রকাশ করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব রাঘববোয়াল ঋণগ্রহীতা দেশ থেকে যাতে পালাতে না পারেন সে জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে জনগণের আমানতের অর্থ আদায় করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, শুধু তাদের হিসাবেই ব্যাংকিং খাতে গত ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকার যে বছর ক্ষমতা গ্রহণ করে ওই বছর ২০০৯ সালে দেশে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে ৭২৭ শতাংশ। কিন্তু প্রকৃত হিসাবে খেলাপি ঋণ প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। অনেক ঋণ আছে যা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিত করে রাখা হয়েছে; যা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। আবার প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার ঋণ আছে, যা প্রায় আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে, এ ঋণখেলাপি ঋণের বাইরে আলাদা করে রাখা হয়েছে, যা ব্যাংকিং ভাষায় অবলোপন বলা হয়। এ ছাড়া বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট কখনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েই বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করা হয়েছে। এসব ঋণখেলাপি ঋণের বাইরে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু ব্যাংক উদ্যোক্তা যোগসাজশের মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ ঋণের নামে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন, বছরের পর বছর যা পরিশোধ করা হচ্ছে না। এমনকি ঋণের বিপরীতে সুদও পরিশোধ করা হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম, কেলেঙ্কারি, দুর্বল করপোরেট গভর্ন্যান্স ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবের ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তারা আরো জানান, সরকার খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে প্রকৃত পরিমাণ তার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর অর্থ বিতরণকৃত ঋণের ১১.১০ শতাংশই খেলাপি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অনেক মন্দ ঋণ আছে যেগুলো এখনো প্রকাশ হয়নি। ভবিষ্যতে সেগুলো প্রকাশ করা হবে। উচ্চ মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং ভালো ঋণগ্রহীতাদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগ ঋণই অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেয়া হয়েছে, তাই সেসব ঋণ আদায় করা কঠিন। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজই হবে ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা ঋণ পরিশোধ করছেন না তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; অন্যথায় দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না।