(গতকালের পর)
আতাতুর্কের পরিকল্পনা অনুযায়ী তুরস্ক থেকে ইসলামী আকীদা বিশ্বাস এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করে ইহুদি-খ্রিস্টানদের আদর্শ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। তুরস্কের মুসলমানরা যাতে ইসলামকে জানতে না পারে তার জন্য যেমন কুরআন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তেমনি মাদরাসাসমূহও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অনেক মসজিদ ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত হয়েছিল। হাজার হাজার খ্যাতনামা আলেম-ওলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদদের হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু দেশের জনগণ এই অবস্থাকে মেনে নেয়নি। তারা ফাঁসি, জেল-জুলুম ও নির্যাতনকে উপেক্ষা করে আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের ঝাণ্ডাকে বুলন্দ করার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং আরবিতে কুরআন অধ্যায়ন, মসজিদে আজান দেওয়া, নামাযের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ইসলামী শিক্ষার পাদপিঠ মাদরাসা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তাদের দাবিকে তীব্রতর করে তোলেন। বলাবাহুল্য মাদরাসা শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ২৮ বছরের মধ্যে তুরস্কের চালু থাকা মসজিদসমূহে নামাযের এবং মুসলমানদের মৃত ব্যক্তিদের জানাযায় ইমামতি করার লোকের অভাব দেখা দেয়। গোটা জাতি এই জুলুমের বিরুদ্ধে ফুসে উঠে। এই অবস্থায় ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনসটন চার্চিল তুরস্ক সফরে আসেন। তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান ইস্মত ইনুনুর সাথে বৈঠক করে বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থার আলোকে তুরস্কে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন। এই অবস্থায় কামাল আতাতুর্কের রিপাবলিকান পিপলস পার্টির দুইজন এমটি জালাল বায়ার ও আদনান মেন্দারেস ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এদিকে আন্দোলনরত আলেমদের চাপ বাড়তে থাকে। বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসি তার বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ রিসালায়ে নূরের মাধ্যমে তুরস্কের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শাসক শ্রেণি কর্তৃক ইসলামের বিরুদ্ধে সৃষ্ট সকল ভুল ধারণা এবং ইহুদি-খ্রিস্টান ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সকল প্রোপাগান্ডার দাঁতভাঙ্গা জবাব পেশ করেন। নাস্তিক্যবাদ ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন। ঈমান-আকীদার অনুকূলে তার শক্তিশালী যুক্তি যুবমানসে জিহাদী প্রেরণার সৃষ্টি করে। ঐ সময় আলেম সমাজকে যারা নেতৃত্ব দান করেন এবং কুরআন শিক্ষা অব্যাহত রাখার আন্দোলন চালিয়ে যান তাদের মধ্যে সুলাইমান হিলমি তুনাহান (রা.) স্কিলিসের (রা.) আলী হায়দার, মোহাম্মদ সাঈদ প্রমুখ ছিলেন শীর্ষে। এদের মধ্যে সরকার শেষোক্ত তিনজনকে ফাঁসি দেন। সুলাইমান হিলমি তুনাহান (রা.) নতুন প্রজন্ম যাতে কুরআনকে ভুলে না যায় সেজন্য এক অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করেন। তিনি ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন। পুলিশ ও সরকারি গোয়েন্দারা যাতে দেখতে না পারে সেজন্য নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ট্রেনের টিকেট কিনে ট্রেনের কামরার মধ্যে নিজের ছাত্রদের কুরআন শিখাতেন। তার এই ছাত্ররাই পরবর্তীতে কুরআনকে জিইয়ে রাখার অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় আসার পর আরবীতে আজান প্রচলন ও আরো কয়েকটি ইসলামিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করায় তুরস্কের কামালপন্থী সেনাবাহিনী তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং ১৯৬০ সালে সামরিক জান্তারা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দারেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং আরবীতে আজান প্রচলনের দায়ে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। তারপর বামপন্থী ও ইহুদি ম্যাশন হিসেবে পরিচিত সুলাইমান ডেমিরেল, আদনান মেন্দারেসের নাম ব্যবহার করে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করে। তার সময় কোনো ইসলামী আন্দোলনও পরিচালনার সুযোগ দেয়া হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে এ আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
মিল্লিগুরুশের প্রতিষ্ঠা : প্রখ্যাত বিজ্ঞানী নাজিমুদ্দিন এরবাকান সমসাময়িক আলেম ওলামাদের পরামর্শে ১৯৬৯ সালে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে এমপি হন এবং সে সময়ের সকল ইসলামী সংগঠনের পরামর্শে ১৯৬৯ সালে মিল্লিগুরুশ নামে একটি রাজনৈতিক প্লাটফরম গঠন করেন। এর অর্থ হচ্ছে জাতির স্বপ্ন। এখানে তিনি মিল্লিগুরুশকে স্থান কাল পাত্রভেদে ব্যবহার করতেন। যেহেতু তুরুস্কে ইসলামের নাম নেয়া নিষিদ্ধ ও ইসলামী দল করাও নিষিদ্ধ ছিল তাই তার এই আন্দোলন আলেম সমাজও নিষ্ঠাবান মুসলমানদের সহায়তায় অল্প সময়ে সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করে এবং তিনি কোয়াশিলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হয়। তার আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বিতা, আমেরিকা ও রাশিয়ার প্রভাব থেকে স্বতন্ত্রভাবে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতি করে নতুন এক তুরস্ক গঠন, আধ্যাত্মিক উন্নতি, ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া জাতিকে পুনরায় ইসলামের দিকে আহ্বান ও যোগ্য মুসলিম রূপে গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা। ইসলামিক ইউনিয়ন গড়ে তোলা ও সকল মুসলিমকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে এসে সকল সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করা। তার এই কোয়ালিশন সরকারের সময় কয়েদ খানা থেকে ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেয়া, সাইপ্রাসকে গ্রীস থেকে দখল করা ও মুসলমানদের যুলুম মুক্ত করা, নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করাসহ অনেক কাজ করেন। তার এই সকল কাজের কারণে মিল্লিগুরুশের রাজনৈতিক শাখা মিল্লি নিজাম পার্টিকে ইসলামী ফান্ডামেন্টালিস্ট হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মিল্লি সালামত পার্টি। কিন্তু এর পরপরেই ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ তে তুরস্কের কনিয়াতে কুদস দিবস পালনের অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ তে-সামরিক অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ তে সামরিক বাহিনী ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে দেয়। সেই সাথে সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়।
তার উপর এই সকল জুলুম নির্যাতন ও তাকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার পরও ১৯৮৩ সালে তিনি রেফাহ পার্টি গঠন করেন। এই পার্টি খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে। এবং ১৯৮৭ সালে এরবাকানের উপর থেকে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারো রাজনীতিতে আসেন এবং রেফাহ পার্টির প্রেসিডেন্ট হন। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই এই পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে স্থানীয় মেয়র নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয় লাভ করে সরকার গঠন করেন। নাজিমুদ্দিন এরবাকান তার ১১ মাসের শাসনামলে ডি-৮ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুদের হারকে কমিয়ে নিয়ে আসেন। এবং জনগণের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন। ক্ষমতা গ্রহণের তিন মসের মধ্যে সকলের বেতনকে ১০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেন। মাত্র ১১ মাসে দেশকে ৩৩ বিলিয়ন সুদ দেওয়া থেকে রক্ষা করেন। তার-প্রবর্তিত নতুন অর্থ ব্যবস্থার আলোকে তিনি আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংককে বলে দেন যে তিনি তাদের থেকে-আর কোন ঋণ নিতে চান না। এইভাবে তিনি দেশবাসীকে জানিয়ে দেন যে, আগামী ৫ বছরে তুরস্ক জার্মানি ও ফ্রান্সের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। তার সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তী সরকার কর্তৃক বন্ধ ঘোষিত ২৭০টি ভারী শিল্পকে পুনরায় উৎপাদনে নিয়ে আসেন। সর্বোপরি, তিনি এক বিশ্ব ইসলামী বিপ্লবের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তার এই সকল উত্তরোত্তর সফলতায় ইহুদিরা রেফাহ পার্টিকে বন্ধ করার লক্ষ্যে সকল প্রকার প্রোপাগান্ডা চালায় ও তার পার্টি শরীয়ত কায়েম করবে এই অভিযোগে তাকে সরানোর জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এই অবস্থায় এরবাকান এই শর্তে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে ইস্তফা দেন যে, তার কোয়ালিশন পার্টির নেত্রী তানসুকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে।
চরম জুলুম নির্যাতন : এরবাকান ক্ষমতা থেকে সরে পড়ার সাথে সাথেই ম্যাশন ও ইহুদিদের ধারক সোলাইমান দেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুজে ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী করে। এইভাবে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তাকেও রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। এবং তাকে ঐ দিনই গ্রেফতার করে জালিম সরকার জুলুম নির্যাতন শুরু করে। এই সময় রেফাহ পার্টির স্থায়ী অস্থায়ী সকল সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করা হয়। যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এই অবস্থায় তুরস্কের ও ইউরোপের লাখো জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। কিন্তু এরবাকান সংঘাত ও রক্তপাত এড়ানোর জন্য তার সকল নেতা কর্মীকে ঘরে ফিরে ধৈর্য্য ধারণ করতে বলেন। কিছুদিন পূর্বে এক জেনারেল তার জবানবন্দিতে বলেন, আমাদের টার্গেট ছিলো সকল সম্ভাবনাময় নেতৃত্বকে হত্যা করা। কিন্তু এরবাকান এর এই কৌশলের কাছে আমরা হেরে যাই। সকল মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করে রেফাহ পার্টির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। হিজাবের উপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পৃথক স্কুলগুলোতে পুনরায় সহশিক্ষা চালু করে। এর ৩ মাস পরে পুনরায় নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। এরপরে মিল্লিগুরুশের অপর নেতা রেজাই কুতানের মাধ্যমে ফজিলত পার্টি ১১১টি আসন পায়। সেই সময়ে এরবাকানও এরদোগানসহ সকল হেভিওয়েট নেতৃত্ব জেলে থাকা সত্ত্বেও এবং তাদের স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত কার পরও এই বিজয় শত্রুদের শংকিত করে তুলে। এবং কিছুদিনের ব্যবধানে ফজিলত পার্টিকেও নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ২০০১ সালের ২০ জুলাই সাদাত পার্টি যাত্রা শুরু করে। কিন্তু মিল্লিগুরুশের ভিতরে তরুণ প্রজন্ম ও নতুনদের নেতৃত্বে নেয়ার নামে ইসলামের আগে লিবারেল ডেমোক্রেসিকে নিয়ে আসেন কতিপয় নেতা। তারা পরবর্তীতে মিল্লিগুরুশকে ভেঙে করেন একে পার্টি, মিল্লিগুরুশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সাদাত পার্টি রয়ে যায় ইসলামী দল হিসাবে। আর একে পার্টি তাদের সকল দৃষ্টিকোন পরিবর্তন করে লিবারিজমের আদলে গড়ে উঠে। (চলবে)