সালাত ইসলামের দ্বিতীয় ভিত্তিস্তম্ভ। এই ইবাদতটি সঠিকভাবে আদায় করলে মানুষের সীমাহীন দৈহিক ও আত্মিক প্রশান্তি লাভ হয়। জাগ্রত হয় আল্লাহ ও বান্দার মাঝে নিবিড় বন্ধনের সুখানুভূতি। যেটা প্রতিটি মানুষের চিরকামনার বিষয়। ইহার মাধ্যমে আল্লাহর মহত্ব ও শক্তির কথা স্মরণ করা হয়। সালাতে ভীতি-বিনয়ী, মনযোগী ও যত্নবান হওয়া আল্লাহর অসীম ক্ষমতা, তাঁর প্রতি ভয় ও শ্রদ্ধা জাগরুক হওয়ার প্রধান উপায়। সালাত মুমিনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যের প্রতীক। মহান আল্লাহর প্রিয়পাত্র ও নৈকট্যশীল হওয়ার প্রধান মাধ্যম। মহানবী (সা.) বলেছেন, “আমাদের তথা ঈমানদারদের মাঝে ও মুনাফিকদের মাঝে পার্থক্য বুঝার উপায় হলো সালাত। যে সালাত ছেড়ে দিবে সে অবশ্যই কাফের হয়ে যাবে”। (আবু দাউদ ১/১৮২, তিরমিজী ১/১১৭) আব্দুল্লাহ ইবনে বুরাইদা তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মুসলমান ও অন্যদের মাঝে মূল পার্থক্য হলো সালাত। যে ব্যক্তি সালাত পরিত্যাগ করবে সে কাফের হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি : ২৬২১)
সালাতের গুরুত্ব : পবিত্র কুরআন ও হাদিসে সালাত আদায়ের আদেশ, সালাত আদায়ের এ নির্দেশনা উপেক্ষার ভয়াবহ শাস্তি এবং সালাত আদায়ের বিনিময়ে অপরিসীম সওয়াবের কথা বর্ণিত হয়েছে। একমাত্র মহানবী (সা.) প্রদর্শিত নিয়মানুযায়ী সালাত আদায় করলেই সালাত কবুল হবে, আল্লাহ তায়ালার নিকট কাংখিত পুরস্কার পাওয়া যাবে, তাই যেভাবে প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) তা আদায় করতেন, একমাত্র সেটাই আমাদের অনুকরণ-অনুস্মরণ করতে হবে। আফসোসের বিষয় হলো, সারা পৃথিবীর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মুষ্টিমেয় কিছু মুত্তাক্বী বান্দা ব্যতীত অনেক মানুষের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটির প্রতি অমনোযোগিতা স্পষ্ট, গাফেল আচরণ দৃশ্যমান। কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত বক্তব্যের ভেতরে সালাতে আগ্রহী হওয়ার পন্থা ও পদ্ধতির কথা ফুটে উঠেছে যথাযথভাবে। কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘এবং ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য লাভ কর। সালাতকে অবশ্যই কঠিন মনে হয়। কিন্তু তাদের পক্ষে (কঠিন) নয়, যারা খুশু অর্থাৎ ধ্যান ও বিনয়ের সঙ্গে সালাত আদায় করে। যারা এ বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখে যে, তারা তাদের রব বা প্রতিপালকের সঙ্গে মিলিত হবে এবং তাদেরকে তারই কাছে ফিরে যেতে হবে।’ (সুরা বাকারা : ৪৫-৪৬) আয়াতে উল্লিখিত ‘খুশু’ শব্দ দ্বারা অক্ষমতা ও অপারগতাজনিত সেই মানসিক অবস্থা বোঝানো হয়েছে, যা আল্লাহ তায়ালার মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও দীনতার অনুভূতি থেকে সৃষ্টি হয়। এর ফলে ইবাদত-বন্দেগী সহজতর হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তিনি কঠিনযন্ত্রনাদায়ক শাস্তি দেয়ার পূর্ণ অধিকার রাখেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের হিসেব তার কাছে অবশ্যই দিতে হবে, এসব বিষয় স্থিরচিত্তে স্মরণ করলে সালাতে মনোযোগী হওয়া সহজ হবে।
সালাতের প্রতিদান ও পুরস্কার : প্রতিদানের কথায় মানুষ উৎসাহিত হয়। সংশ্লিষ্ট কাজের প্রতি মনোযোগী ও আগ্রহী হয়ে ওঠে। অসংখ্য হাদিস শরীফে সালাতের প্রতিদান স্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ, গুনাহ মাফ, জাহান্নাম থেকে মুক্তি, সফলতা অর্জন ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। সফলকাম মুমিনের গুণ বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, ‘সফলকাম হলো ঐসব মুমিন’ ‘যারা তাদের সালাতে গভীরভাবে মনোযোগী’ ‘যারা তাদের সালাতসমূহের হেফাযত করে’ (মুমিনূন ১ ও ৮) নবী করিম (সা.) বললেন, ঈমানের পর সবচেয়ে উত্তম ইবাদত হলো সঠিক সময়ে সালাত আদায় করা।’ (বুখারি : ৭৫৩৪)।
আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত সালাত তার মধ্যবর্তী সময়ের, এক রমজান থেকে আরেক রমজান তার মধ্যবর্তী সময়ের, এক জুমুয়া থেকে আরেক জুমুয়ার মধ্যবর্তী সময়ের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন। যদি বান্দা কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। ’ (মুসলিম : ২৩৩)।
ইবন উমার (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যথাসময়ে যথা নিয়মে সালাত আদায় করবে, ওই সালাত তার জন্য কেয়ামতের দিন আলো, প্রমাণ ও নাজাতের মাধ্যম হবে। আর যে ব্যক্তি সঠিকভাবে সালাত আদায় করবে না, তার জন্য তার সালাত কেয়ামতের দিন নূর, দলিল ও নাজাতের মাধ্যম হবে না। কেয়ামতের দিন সে কারুন, ফিরআউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের সঙ্গে থাকবে। ’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৫৭৫)
সালাতে উদাসীন ও অমনোযোগী ব্যক্তিদের প্রতি তিরস্কার ও শাস্তি: সালাতের প্রতি উদাসীন ও অমনোযোগী ব্যক্তিদের প্রতি তিরস্কার ও শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে অপরাধীদের সম্পর্কে যেকোনো জিনিস তোমাদেরকে জাহান্নামে দাখিল করেছে? তারা বলবে, আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না।’ (সুরা মুদ্দাসসির : ৪১-৪৩) অপরদিকে যারা সালাতে উদাসীন থাকবে তাদের কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “ঐসব সালাত আদায়কারী জন্য ওয়াইল বা ধ্বংস, যারা তাদের সালাতের ব্যাপারে গাফেল।” (সূরা মাউন: ৪-৫)।
অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারপর তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো এমন সব লোক, যারা সালাত নষ্ট করল এবং ইন্দ্রিয় চাহিদার অনুগামী হলো অর্থাৎ মন যা চায় তাই করতে লাগলো। সুতরাং তারা অচিরেই তাদের ‘গাঈ’তথা পথভ্রষ্টতার মাঝে নিক্ষিপ্ত হবে, সাক্ষাৎ পাবে কঠিন গর্তওয়ালা জাহান্নামের।’ (সুরা মারয়াম : ৫৯)। আয়াতে উল্লিখিত ‘গাঈ’ শব্দের তাফসিরে ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, সেটা হলো জাহান্নামের একটি গর্ত, যার উত্তাপ অত্যন্ত বেশি, যদ্দরুন জাহান্নামের অন্যান্য গর্ত আল্লাহ তায়ালা কাছে তার থেকে পানাহ চায়। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘গাঈ’ জাহান্নামের একটি গর্ত, এতে সমগ্র জাহান্নামের চাইতে অধিক আজাবের সমাবেশ রয়েছে। (তাফসীরে ফতহুল কাদির ৩/২৪৪)
সালাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি: সঠিকভাবে সালাত আদায় করার ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সা.) দেখানো পন্থাই একমাত্র সঠিক পথ। প্রিয় নবীজির (সা.) দেখানো তরীকা অনুস্মরণ করে সালাতের মাঝে গভির মনোনিবেশ করতে হয়। সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) প্রদর্শিত পদ্ধতি ও তরিকা হুবহু অনুসরণ করতে হবে।
রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন: “আমি যেভাবে সালাত আদায়করি তা দেখে সেভাবেই তোমরা সালাত আদায় করবে অর্থাৎ তোমরা সেভাবে সালাত আদায় কর যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ।” (বুখারী-,”। (বুখারী ৩/৭ হাদিস সংখ্যা- ৬৩১. মুসলিম: ৪২৮-মুসলিম) সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে তা আদায় করেও অনেকে পাপের ভাগী হবে। আর তা হবে ভয়াবহ জাহান্নাম।
কুরআন মাজীদ ও হাদিস শরিফে সালাতের ব্যাপারে মৌলিক কয়েকটি পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। যথা:-
ক. ইক্বামাতে সালাত বা সালাত কায়েম করা খ. হেফাজাতে সালাত বা সালাত হেফাজত করা গ. খুশু-খুদু বা সালাতে ভীত ও বিনয়ী হওয়া। আলোচ্য পদ্ধতিসমূহ সবই কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে পাওয়া যায়।
ক. ইক্বামাতে সালাত বা সালাত কায়েম করা:- পবিত্র কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে সালাত কায়েমের ব্যাপারে বার বার উল্লেখিত হয়েছে। মুত্তাক্বীদের বিশেষ গুণাবলী আলোচনা করতে যেয়ে আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেন, “এই কুরআন মুত্তাক্বীদের জন্য সঠিক পথের দিশারী যারা সালাত কায়েম করে...” (সুরা বাকারাহ-৪)
ইক্বামাতে সালাত এর তাফসিরে কয়েকটি ব্যখ্যা পাওয়া যায়:- আল্লামা নাসিরুদ্দিন বায়জাবী বলেন: ইক্বামাতে সালাতের অর্থ হলো-
১. তা’দিলে আরকান তথা সালাতের রুকু, সাজদাহ, বৈঠক ইত্যাদি ঠিক ঠাক মত আদায় করা। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, “জনৈক গ্রাম্য সাহাবী রা. বিশ্বনবী (সা.) এর নিকটে এসে তাড়াহুড়া করে সালাত আদায় করছিলেন-রুকু, সাজদাহ ও বৈঠকাদি ঠিকমতো আদায় করেননি।
নবিজী তাকে তিন তিন বার দাঁড় করিয়ে বললেন, তুমি দাঁড়াও, পুনরায় সালাত আদায় করো কারণ তুমি সালাত আদায়ই করোনি।” (বুখারী-১/১৭৫) এ জন্য তা’দিলে আরকান সালাতের জন্য একান্ত জরুরি।
