নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলি দিয়ে শত শত বিক্ষোভকারী ও পথচারীর চোখে আঘাত করা হয়েছিল যারা চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত সোমবারের এক প্রতিবেদনে ঢাকায় বিক্ষোভে পেলেট গানের শিকারদের করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অফথালমোলজি অ্যান্ড হসপিটালের (এনআইওএইচ) জীবাণুমুক্ত দেয়ালের মধ্যে একটি করুণ দৃশ্য ফুটে উঠেছে। কয়েক ডজন যুবকের মুখ দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তায় ছেয়ে গেছে, চুপচাপ বসে আছে তারা। কেউ কেউ গাঢ় সানগ্লাসের আড়ালে তাদের আহত চোখকে রক্ষা করছে। অন্যরা এক বা উভয় চোখে সাদা ব্যান্ডেজ পরে আছেন।
একটা প্রশ্ন সবার চোখে মুখে, এই মানুষগুলো কি আর কখনো পৃথিবীকে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবে? তারা পেলেটের আঘাতের শিকার। তাদের অবস্থা চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর মারাত্মক ক্র্যাকডাউনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর চালানো এই অভিযান প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ১৭ কোটি মানুষের দেশকে গ্রাস করেছিল। হতভাগাদের মধ্যে মোহাম্মদ অনিক, মাদারীপুরের ২৪ বছর বয়সী বিক্রয়কর্মী। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধকারী এনআইওএইচ-এর একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, ‘তার (অনিক) দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশেরও কম। তার দুই চোখে বেশ কিছু আঘাত ছিল এবং আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।
ঘটনার দিন সোমবার অনিক কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে আটকা পড়েন। কী ঘটছে তা বোঝার আগেই একটি গুলি তার মুখে লেগে যায়। তিনি মাটিতে পড়ে যান, অজ্ঞান হয়ে উন্মুক্ত হয়ে পড়েন। যতক্ষণ না পথচারীরা হস্তক্ষেপ করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় ততক্ষণের কথা তিনি কিছু জানেন না। তিনি নিজেকে এনআইওএইচ-এর কয়েক ডজন যুবকের মধ্যে খুঁজে পান, যাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে আছে।
পেলেট বন্দুকের শত শত রোগী আহত : এনআইওএইচ গত কয়েক দিনে প্রায় ৫০০ রোগীর চিকিৎসা করেছে, যারা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আগত, সবাই চোখে গুরুতর আঘাতে ভুগছেন। হাসপাতালের রেকর্ডে দেখা যায় যে এসব ব্যক্তির মধ্যে অন্তত ২৭৮ জনের শরীরের অন্যান্য অংশেও ক্ষত রয়েছে।
গত শুক্রবার রাজধানীর মিরপুর এলাকায় পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় একটি মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপে কাজ করা ১০ বছর বয়সী মোহাম্মদ শামীম দুই চোখেই পেলেটের আঘাত পান। চিকিৎসকরা বলেছেন যে তিনি কখনোই তার দৃষ্টি পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন না। তার বাবা মোহাম্মদ ইদ্রিস করুণভাবে বলেন, ‘আমার ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে খারাপ লাগছে। আমি তার সাথে কী করতে যাচ্ছি?’
এনআইওএইচের পরিচালক গোলাম মোস্তফা নিশ্চিত করেছেন যে কোটাবিরোধী বিক্ষোভের সময় ব্যবহৃত শটগানের গুলিই আহত হওয়ার প্রাথমিক কারণ। যেক্ষেত্রে পেলেটটি নিজেকে রেটিনার কেন্দ্রে এম্বেড করে বা জোর করে আঘাত করে বের করে দেয়া হয় সেক্ষেত্রে আংশিক অন্ধত্ব তার দুঃখজনক পরিণতি হয়ে ওঠে।
যে গবেষকরা ভারতশাসিত কাশ্মিরে বিক্ষোভকারীদের পেলেটের আঘাত দেখেছেন তারা আগে থেকে জানেন, যখন খুব কাছ থেকে গুলি চালানো হয়, তখন পেলেটগুলি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না, যার ফলে একটি ঘনীভূত ক্লাস্টার হয় যা অবিশ্বাস্যভাবে উচ্চগতিতে চলে। এই ঘনীভূত শক্তি পেলেটগুলোকে হ্যান্ডগানের বুলেটের মতো প্রজেক্টাইলে রূপান্তরিত করে, যা নরম টিস্যুতে, বিশেষ করে চোখের গভীরে ছিদ্র করতে সক্ষম, ব্যাপক এবং অপরিবর্তনীয় ক্ষতি ঘটায়।
গবেষণায় বলা হয় যে, দৃষ্টিশক্তির ওপর পেলেট বন্দুকের বিধ্বংসী প্রভাব গুলি চালানোর বেগ এবং দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। এই আঘাতের তীব্রতার কারণে এর ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিন্দা সৃষ্টি হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কয়েক বছর আগে ভারত-শাসিত কাশ্মিরে ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিল।
জাতিসঙ্ঘের জারি নির্দেশিকা লঙ্ঘন : জাতিসঙ্ঘ আইন প্রয়োগে পেলেটগান ব্যবহার করার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে। অনেকগুলো ছবি এবং ফুটেজ বিশ্লেষণের পর আল জাজিরাকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশী পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী ১২-গেজ পাম্প-অ্যাকশন শটগান ব্যবহার করেছে যাতে এই ধাতব গুলো রয়েছে।
আলজাজিরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশ বাহিনীর একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে টেলিফোন এবং টেক্সট বার্তা পাঠিয়েছে কিন্তু কোনো সাড়া পায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ আল জাজিরাকে বলেছেন যে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ‘কোন প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তা তাকে ‘পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর সাথে কথা বলে জানতে হবে’।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভের সময় অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ করেছে। তাদের অনুসন্ধানে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য লাইভ গোলাবারুদ, টিয়ার গ্যাস, স্টান গ্রেনেড, রাবার বুলেট এবং শটগান পেলেটের ব্যবহার প্রকাশ করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
কোটাবিরোধী বিক্ষোভকারীরা তাদের পরিবারের সাথে দাবি করে যে, পুলিশ নির্বিচারে বলপ্রয়োগ করেছে, তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে। বিক্ষোভে অংশ নেন দক্ষিণ জেলা বরিশালের রাকিবুল আহসান। বিএম কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আহসান গত মঙ্গলবার তার সহপাঠীদের নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তখন তার দুই চোখেই গুলি লাগে। চিকিৎসকরা তাকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আশ্বাস দেননি। আহসান বিলাপ করে বলেন, ‘আমরা একটি বৈধ কারণের জন্য প্রতিবাদ করছিলাম এবং এর জন্য গুলি করা হয়েছিল। এখানে কোনো ন্যায়বিচার নেই।’
মাদারীপুরের রাজমিস্ত্রি সুমন মিয়ার ডান চোখেও গুলি লেগেছে। তিনি সেলসম্যান অনিকের সাথে হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে ছিলেন। তবে আহসান এবং অনিকের মতো তিনি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িত ছিলেন না। তিনি কেবল কাজ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। একটি অস্ত্রোপচার করা সত্ত্বেও, ডাক্তাররা তার চোখটি বাঁচাতে পারেনি, তার দৃষ্টি হারিয়ে গেছে।
তার বোন লিপি আক্তার জানতে চান, ‘আমার ভাই কোনো প্রতিবাদে জড়িত ছিল না। কেন তাকে গুলি করা হয়েছিল? এর জন্য কাকে দায়ী করা হবে?’