বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গুলিতে নাকি ইটপাটকেলে মারা গেছে- এ নিয়েই চলছে বিতর্ক। পুলিশের করা একটি মামলা নিয়েই বিষয়টি সামনে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। শিক্ষকরা বলছেন, সাঈদ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেটি করা হলে পুলিশের প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সুস্পষ্ট হত্যা মামলা দাবি করেছেন তারা। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট।
পুলিশ কমিশনার বলেছেন, এফআইআর চুড়ান্ত কিছু না, এটা তদন্তের শুরুর বিষয়মাত্র। আমরা এ ঘটনা তদন্ত করব পেশাদারিত্বের মাধ্যমে। যেই দোষী হবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি অনুরোধ করব সবাই একটু ধৈর্য ধরুন অপেক্ষা করুন। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন, আমাদের একটু সময় দিন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাংলা ব্লোকেড কর্মসূচি চলাকালে গত ১৬ জুলাই বেলা পৌনে ২টার দিকে বেরোবির ১ নম্বর গেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ঘটনাটি দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে ব্রেকিং নিউজের চাংকে উঠে যায়। এই মৃত্যু নিয়ে সে দিন কথা বলেছিলেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের পরিচালক মো: ইউনুস আলী। তিনি সে দিন জানান, বিকেল সোয়া ৪টার দিকে হাসপাতালে ২৫ বছর বয়সের আবু সাঈদ নামের একটি রোগী আসে। সেটি ব্রড ডেড ছিল। অর্থাৎ মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। তার গায়ে রাবার বুলেটের মতো অনেক আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরের দিন শিক্ষকরা সাঈদের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড দাবি করে সুষ্ঠু বিচার ও তদন্তের দাবিতে ক্যাম্পাসের ১ নম্বর গেটের সামনে মানববন্ধনও করেন। দাবি ওঠে গুলিকারী পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার।
মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ওই দিন রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে আবু সাঈদের মৃত্যু ও সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় তাজহাট থানায় এজাহার দাখিল করেন এসআই বিভূতি ভূষণ রায়। ১৭ জুলাই মামলাটি রেকর্ড হলেও কপি থাকে আড়ালে। সেই মামলার কপি প্রকাশ্যে আসে ২৬ জুলাই। এ নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। এজাহারের একপর্যায়ে বাদি লেখেন, ‘বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে একজন শিক্ষার্থীকে পড়ে যেতে দেখা যায়। তখন সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য বিকেল ১৫.০৫ ঘটিকার সময় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত ছাত্রের নাম আবু সাঈদ (২৩), পিতা- মকবুল হোসেন, সাং-জাফড়পাড়া বাবনপুর, থানা-পীরগঞ্জ, জেলা রংপুর বলে মেডিক্যাল সূত্রে জানা যায়।’
সাঈদের মৃত্যু নিয়ে পুলিশের এই লেখাতেই আপত্তি সবার। সহপাঠী, এলাকাবাসী, পিতা-মাতা, শিক্ষকরা সবাই ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছেন এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশকে এই হত্যার দায় থেকে বাঁচানোর জন্যই শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে।
সাঈদের পিতা মকবুল হোসেন বলেন, ‘সাঈদকে গুলি করে মারার বিষয়টি যেন উল্টে না যায়। সঠিক বিচার চাই আমরা। ওই ছইলই আমার সবকিছু ছিল। যে গুলি করে হত্যা করেছে। তার বিচার চাই আমি। ঘটনাটা যাতে পুলিশ বা কেউ উল্টাতে না পারে সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই, তিনি যেন আমাদের বধূমাতা হিসেবে এই হত্যার বিচার করে দেন।’
সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে এত কষ্ট করেছে। প্রাইভেট পড়িয়ে আমাদের বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে। আমরা সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাই। আমার ছেলেকে যে হত্যা করেছে তার বিচার চাই আমি।’
বেরোবির বাংলা বিভাগের প্রধান সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য ও শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ড. তুহিন ওয়াদুদ পুলিশের মামলার এজাহারের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বলেছেন, আবু সাঈদকে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ গুলি করেছে। সেই গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হয়েছে। এটা একটা হত্যাকাণ্ড। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতিতেও সেটি দৃশ্যমান। গুলিতে নিহত আবু সাঈদের সেই ঘটনাটাকে যদি অস্বীকার করা হয়, ধামাচাপা দেয়া হয়, যা পুলিশ তাদের মামলার এজাহারে লিখেছেন; তাহলে এটা আসলে হিতে বিপরীত হবে।
মামলার প্রাথমিক তথ্যবিবরণী (এফআইআর) নিয়ে বিভিন্ন মহলের ক্ষোভের বিষয়ে রংপুর মহানগর পুলিশ পুলিশ কমিশনার মো: মনিরুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, মামলা কী হয়েছে সেটি অবশ্যই একটি বিষয়। এফআইআর হচ্ছে ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট। এটার মধ্যে অনেকসময় ভুল থাকে। ত্রুটি থাকে। সব তথ্য থাকে না। যখন এফআইআরটা হয়েছে তখন কিন্তু পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট ছিল না। শুধু সুরতহাল রিপোর্ট দেখেই এফআইআর হয়েছে। সব ফুটেজ তখনো পাওয়া যায়নি। স্রেফ একটা ঘটনার বিবরণ দিয়ে এফআইআর হচ্ছে- দিস ইস এ ডকুমেন্টস টু স্টার্ট ইনভেস্টিগেশন। এটা তো চূড়ান্ত কোনো কিছু না।
পুলিশ কমিশনার বলেন, এফআইআর যাই হোক তদন্ত প্রক্রিয়াটি অবশ্যই আমরা প্রফেশনালি করার চেষ্টা করব। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন হয়েছে সেই কমিশনও আমার ধারণা এই বিষয়টি দেখবে। তারাও এই বিষয়ে তাদের মতামত দেবেন।
পুলিশ কমিশনার বলেন, আমি অনুরোধ করব সবাই একটু ধৈর্য ধরুন। অপেক্ষা করুন। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। আমাদের একটু সময় দিন। আমরা যে প্রক্রিয়াতে জানমালের ক্ষতি এড়ানোর চেষ্টা করেছি, সে প্রক্রিয়াতে কোনো নিরীহ মানুষ ধরপাকড় করিনি। সেই একই প্রক্রিয়াতে তদন্তসহ ভবিষ্যতে সব কার্যক্রম সম্পন্ন করব।
রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সঙ্ঘাত সংঘর্ষে সাতজন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনায় রোববার বিকেল পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১৪টি। গ্রেফতার হয়েছে ২১৮ জন। আরো মামলা প্রক্রিয়াধীন।
বাম জোটের বিবৃতি
পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাঁচাতে সাঈদ হত্যার দায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানোর ষড়যন্ত্র চলছে বলে দাবি করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে রংপুর বাম জোট।
রোববার (২৮ জুলাই) বাম গণতান্ত্রিক জোট রংপুর জেলার নেতৃবৃন্দ যথাক্রমে আনোয়ার হোসেন বাবলু, আব্দুল কুদ্দুস ও কাফি সরকার এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, শান্তিপূর্ণ কোটা আন্দোলন দমন করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিকল্পিতভাবে সাঈদকে গুলি করে হত্যা করেছে। দেশবাসীসহ সারা বিশ্ব তা প্রত্যক্ষ করেছে। পুলিশের গুলি করার ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ মানুষ এই ঘটনা দেখেছে। অথচ বেরোবি পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায় দুই/তিন হাজার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে যে মামলা করেছে তা আমাদেরকে বিস্মিত করেছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, এমন বক্তব্যের একটাই উদ্দেশ্য বলে আমরা মনে করি- তা হলো খুনি পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা। এ ছাড়া ওই ঘটনার সময় পুলিশকে গুলি করতে উৎসাহ প্রদানকারী ছাত্রলীগের সাথে হেলমেট পরা দুই বেরোবি শিক্ষক আসাদুল ইসলাম আসাদ ও মশিউর রহমানকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।