‘আমার ছেলে দোকানে যাইবার কথা বইল্যা গেল, বাড়িত আইলো লাশ হয়ে। সে কোনো রাজনীতি করত না। ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে তার মুখে কোনো কথা কখনো শুনিনি। আমরা তো জানি না কিসের আন্দোলন। কেন পুলিশ গুলি করল? এমন বিনয়ী ছেলের মৃত্যুতে আমার আফসোস নেই।’ কিছুটা আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহে কোটাবিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত জোবায়ের আহমেদের বাবা অবসরপ্রাপ্ত মাদরাসাশিক্ষক আলহাজ মৌলভী মো: আব্দুল আনোয়ার উদ্দিন।
তিনি বললেন, হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন যদি কেউ তার সাহাবিদের নামে সন্তানের নাম রাখেন তাহলে শেষ বিচারে তার জন্য সুপারিশ করবেন। সেই কথা মনে রেখে একজন সাহাবির নামানুসারে আমার ১০ সন্তানের অস্টম সন্তান জোবায়ের আহমেদের নাম রাখা হয়। সেই ছেলের তকদিরে এমন মৃত্যু ছিল। সে বিনাদোষে শহীদ হলো। আমার বিশ^াস মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: আমার ছেলের জন্য হাশরের ময়দানে সুপারিশ করবেন। মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন তাকে জান্নাতবাসি করবেন এটাই আমার কামনা। গতকাল রোববার বিকেলে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার কাওরাট গ্রামে নিজ বাড়ির পিত্রালয়ের উঠানে বসে তিনি আলাপ করছিলেন এই প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ভারতের মেঘালয়ের শিবপুর ক্যাম্পে ছিলাম। ছেলের পেছন থেকে গুলি লেগে বুকের বাম পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। আমার ধারণা, আমার ছেলে দোকানে যাওয়ার পথে হয়তোবা মনে করেছে তার কিছু হবে না। সে তো আন্দোলনকারী নয়। তাই যাওয়ার সময় পুলিশ আন্দোলনকারী ভেবে গুলি করেছে! তার যাওয়টাই কাল হলো। এই উসিলায় তার মৃত্যু হলো।
তিনি আরো জানান, গৌরীপুর ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি পাস করে ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফেল করার পর জোবায়ের ব্যবসা শুরু করে। ময়মনসিংহ নগরীর শম্ভুুগঞ্জে তার মোবাইলের দোকান রয়েছে। ভারত থেকে মোবাইল ডিসপ্লেসহ যন্ত্রাংশ আমদানি করে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করত। বসবাস করত গ্রামের বাড়িতেই। ১৩ মাস আগে বিয়ে করেছিল ঈশ^রগঞ্জ উপজেলা বিপচাঁশি গ্রামের মর্জিনাকে। দুই দিন আগে বিধবা স্ত্রীকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যান ওর বাবা। যাওয়ার সময় পুত্রবধূ শুধু কান্না করেছে, কিছু বলে যায়নি। জানি না ওর ভাগ্যে কী আছে! ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বসতঘরেই শেষবারের মতো কথা হয় ছেলের সাথে।
জোবায়ের বাবাকে জানায়, দোকানে যাবে। অনেক দিন ধরে দোকান খোলা হয় না। অনেক কাস্টমার ঘুরে যাচ্ছেন। পেসারের রোগী বাবা আনোয়ার উদ্দিন দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। জোহরের নামাজের সময় একটা ফোন আসে বলে, জোবায়ের গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে তার এক বন্ধু মোবাইলে ফোন করে জানায় জোবায়ের মারা গেছে। বিকেল ৩টার দিকে তিনজন মেয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্সে জোবায়েরের লাশ নিয়ে বাড়ি আসে। পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দেয়া হয়। লাশ রেখে মেয়েরা অ্যাম্বুলেন্সেই চলে যায়। মেয়েদের কারো পরিচয় তিনি জানেন না। বাদ মাগরিব নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জোবায়েরের বাবা জানান, ছেলে মারা গেছে কারো কাছে বিচার চাই না। কিন্তু কষ্ট লাগে এখন পর্যন্ত পুলিশ খোঁজখবর নেয়নি। রাষ্ট্রের কী কোনো দায়দায়িত্ব নেই। আমরা তো সাহায্য চাই না। সরকার যদি মনে করে সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার করুক। অনেকেই বলেছেন মামলা করতে, আমি বলেছি না। আমার ছেলে নির্দোষ। কারো সাথে তার বিরোধ বা আক্রোশ নেই। আমি তো ছেলে ফিরে পাবো না। আমি আল্লাহর কাছে বিচার নয়, ছেলের জন্য জান্নাত চাই- এই বলে সবার কাছে দোয়া কামনা করেন তিনি।