আমার স্বামী গুরুতর অসুস্থ। উচ্চরক্তচাপ, নিউরোর বড় ধরনের সমস্যা থাকায় ভারত থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনা হয়েছে। নিয়মিত ওষুধ না খেলে যেকোনো সময় মারা যেতে পারেন। শনিবার রাত থেকে কোনো ওষুধ খেতে পারেননি। মাগরিবের নামাজরত অবস্থায় তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার স্বামীর ওষুধগুলো অন্তত ভেতরে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। না হলে তিনি মারা যেতে পারেন। এভাই মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ের সামনে আহাজারি করছিলেন শারমিন আক্তার নামে এক গৃহবধূ। শুধু তিনিই নন, তার মতো আরো অনেককেই আহাজারি করতে দেখা গেছে ডিবি কার্যালয়ের সামনে।
মা তার সন্তানের সন্ধানে স্ত্রী স্বামীর আবার কেউ ভাই-বোন ও আত্মীয়দের খোঁজ করতে ভিড় করছেন ডিবি কার্যালয়ের আশপাশে। যদিও এখন পর্যন্ত ডিবির কারো সাথেই তারা দেখা করতে পারেননি। এমনকি অসুস্থ ব্যক্তির জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধটুকুও ভেতরে দিতে পারেননি। তারা বলছেন, কোনো ধরনের কথা না বলেই জোর করে ২০-২৫ জনের দলবদ্ধ পুলিশ বাসা, হাসপাতাল, ব্যবসা/ চাকরির প্রতিষ্ঠানে ঢুকে তাদের ধরে নিয়ে আসছে। কী জন্য ধরে নেয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো কথা বলা হচ্ছে না। কিছু জানতে চাইলে উল্টো পরিবারের লোকজনের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করছে।
গতকাল রোববার মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ের সামনে এমন চিত্র দেখা গেছে। তবে ডিবি পুলিশ বলছে, যাদেরকে নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা নিয়ে এসেছি, তাদের পরিবারের কাছে অনুরোধ করব, দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।
সরেজমিন মিন্টু রোড এলাকায় দেখা যায়, অন্যান্য দিনের তুলনায় ডিবি কার্যালয়ের দু’পাশে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া ও ব্যারিকেড দিয়ে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের লোকজন ছাড়া অপরিচিতরা ঢুকতে গেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের মা মমতাজ বেগমও ছেলের সন্ধানে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, শুধু আমার ছেলেকে নয়, আটক সব ছেলে মেয়েদের যেন ছেড়ে দেয়া হয়। এটা কোনো নিরাপত্তা হতে পারে না। তাদের চিকিৎসা চলছে, আমরা খুবই চিন্তিত। যদি তাদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য হেফাজতে নেয়ার প্রয়োজন ছিল, তাহলে তো পুলিশ হাসপাতালেই তাদের নিরাপত্তা দিতে পারতো। নাহিদকে হেফাজতে নেয়ার পর এখন পর্যন্ত আমাদের কিছু জানানো হয়নি। আমি চাই ছেলেকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিক। এর আগে তুলে নিয়ে নাহিদকে নির্যাতন করা হয়েছে। এখনো ক্ষতস্থান সারেনি। শরীরে জ্বর রয়েছে। তার মধ্যে আবার হাসপাতাল থেকে তাকেসহ আরো দু’জনকে তুলে নেয়া হয়েছে। নাহিদের এক ফুপু বলেন, সর্বশেষ আমি নাহিদকে হাসপাতালে দেখে এসেছিলাম। তখন তার পায়ের ক্ষতগুলো বাজে অবস্থায় ছিল। নাহিদের শারীরিক অবস্থা ভালো না। গায়ে জ্বর ও পায়ে প্রচণ্ড ব্যথার কারণেই হাসপাতালে ভর্তি ছিল।
কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার থেকে ডিবি অফিসে আসা শারমিন আক্তার বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় সাদা পোশাকে একদল লোক স্বামী নাজিম উদ্দিনকে নামাজরত অবস্থায় তুলে নিয়ে যায়। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় তারা বাসায় ঢুকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। মাগরিবের তিন রাকাত নামাজের এক রাকাত বাকি ছিল। সেই নামাজরত অবস্থায় তাকে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে।
তিনি বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের নার্সিং ইনচার্জ। দুই সন্তানকে নিয়ে তারা আঁটিবাজার এলাকায় বাস করেন। স্বামী রানা ফুড বেকারি নামক একটি পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অন্য ভাইদের সাথে দেখাশোনা করেন। তিনি হাইপ্রেসার এবং নিউরো প্যাশেন্ট। ভারত থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনা হয়েছে। তার নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু শনিবার থেকে এখন পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাচ্ছি না। অথচ তুলে আনা ওই টিমের সাথে ডিবির কর্মকর্তা মশিউর রহমান ছিলেন। আমি তাকে দেখে চিনতে পেরেছি। তিনি আকুতি জানিয়ে বলেন, আমার স্বামীর ওষুধটুকু ভেতরে নেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তা না হলে ও মারা যেতে পারে।
তিনি বলেন, রাজনীতি না করা লোকটাকে কেউ ফাঁসালো কি না জানি না। যারা তুলে নিয়ে আসছে, তাদের সাথে কোনো নারী সদস্য ছিল না। আমাদের দুই সন্তান। ৮ বছরের এক ছেলে ও তিন বছর বয়সী এক মেয়ে আছে। মেয়ের হার্টে সমস্যা, কিছু দিন আগে অপারেশন হয়েছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না।
বরিশাল শহরের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকার মুদিদোকানি সোহাগ হাওলাদার। গত ২৪ জুলাই রাজধানীর হেলথ এইড হাসপাতালে ভর্তি থাকা এক স্বজনকে দেখতে এসে নিখোঁজ হন। এরপর আর তার সন্ধান পায়নি পরিবার। কেউ একজন ফোন করে ভাইকে বলেছেন সোহাগ ডিবি কার্যালয়ে আছে। সেই খবর পেয়ে দিন-রাত অপেক্ষা করছেন মা বছিরন বেগম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ছেলের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। শুনেছি তাকে ডিবি পুলিশ তুলে নিয়ে আসছে। এ জন্য ডিবি কার্যালয়ে আসছি। কিন্তু ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।
বছিরন বেগম বলেন, আমার ছেলে বরিশালের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডের মুদিদোকানি। ঢাকা এসেছিল রোগী দেখতে। হাসপাতাল থেকেই তাকে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ছেলের সন্ধানে পাগলপ্রায় এই মা কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে নির্দোষ। কোনো রাজনীতির সাথে সে জড়িত না। আমার স্বামী নেই। এই ছেলেই আমাকে দেখাশোনা করে। তার ১৭ মাসের মেয়ে আছে। তার আয়ে আমার পরিবার চলে। কয়েক দিন আগে আমার আরেক ছেলেকে ডিবি থেকে ফোন করে জানানো হয়েছে, ছেলে সুস্থ আছে।
মোহাম্মদপুর আজিজ মহল্লা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে আনা হয় স্থানীয় সাংবাদিক (তদন্তচিত্র পত্রিকার সম্পাদক) তাহের আহমেদ তাহেরী ও তার ভাগনে সাদ্দামকে। সাদ্দাম রেডএক্স নামক একটি ডেলিভারি সাপ্লাইয়ার কোম্পানির কর্মী। তাহেরীর বোন রাজিয়া মিন্টু রোডে সাংবাদিকদের বলেন, শনিবার রাত ৮টার দিকে তুলে আনা হলো, কেন আনা হলো কিছুই জানানো হলো না। আমি রাতেও আসছি, পরদিন সকালেও আসছি, কিন্তু ডিবি পুলিশ কথা বলছে না। তাহেরী মোহাম্মদপুর ও জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা নিয়ে অনেক রিপোর্ট করেছে। সে কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা ভাগনেসহ তাহেরীকে ফাঁসাতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।
এর আগে দুপুরে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, যাদেরকে নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা নিয়ে এসেছি, তাদের পরিবারের কাছে অনুরোধ করব, দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমরা মনে করি তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা দেখছি। তাদের পরিবার যেন নিশ্চিন্ত থাকে, সেই বিষয়ে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই।