১৯ বছরের টগবগে যুবক মোহাম্মদ আকাশ। পরিবারের আর্থিক অনটনে লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। তাই কৃষক বাবার সংসারে সহযোগিতা করতে চলে আসেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। চাকরি নেন একটি মিষ্টির দোকানে। দোকান মালিক থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করায় বেতনের পুরো টাকাই গ্রামে বাবার কাছে পাঠিয়ে দিতো। ফলে সংসারের আর্থিক সংকট অনেকটাই কেটে যায়। কিন্তু পুলিশের একটি বুলেট আকাশের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। কেটে ফেলতে হয়েছে তার একটি পা। চিরদিনের জন্য পঙ্গত্ব বরণ করেছে সে। পুলিশ আকাশের বুকে বন্দুক তাক করে। হাত দিয়ে নল সরিয়ে দেয়ায় কাছ থেকে পায়ে গুলি করে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোডস্থ চাঁন সুপার মার্কেটের নিচে (পূর্বপাশে) বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কাজ করতো আকাশ। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মদন থানার বিরাশি এলাকায়। প্রতিদিনের মতো ২০শে জুলাই সকালেই দোকানে আসে সে। এদিকে সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল (চিটাগাং রোড) এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। একপর্যায়ে বিকাল ৪টার দিকে পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি ও টিয়ারশেলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ব্যবসায়িদের মাঝে। জীবন বাঁচাতে দোকানের শাটার টেনে থাই গ্লাসের দরজা বন্ধ করে ভেতর অবস্থান করে আকাশ, দোকানের মালিক জাফর আলী ও আরেক কর্মচারী মাসুম। ভেতর থেকে বাইরে গুলির শব্দ পাচ্ছিল তারা। ভয়ে জবুথুবু হয়ে বসে থাকে তিনজন। একপর্যায়ে দোকানে কয়েক রাউন্ড গুলি করে পুলিশ। এতে দোকানের উত্তর পাশের গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। গুলিতে আহত হয় ক্যাশ কাউন্টারে বসা দোকানের মালিক জাফর আলী। পরে দোকানের সামনের দিকের শাটার আর থাইগ্লাস ভেঙে ভেতরে ঢুকে পুলিশ খুব কাছ থেকে আকাশের বাম হাঁটুতে গুলি করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। রক্তে ভেসে যায় দোকানের মেঝে। পুলিশ চলে যাওয়ার পর জাফর আলীকে স্থানীয় ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হয়। আর আকাশকে দ্রুত ঢাকার শ্যামলী এলাকায় একটি প্রাইভেট হসপিটালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ৩ দিন তার চিকিৎসা চলে। কিন্তু চিকিৎকরা পা রক্ষা করতে পারবে না জানালে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৪ দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার দুপুরে চিকিৎসকরা তার বাম পা কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।
হাসপাতালের বিছানায় অসহায়ভাবে শুয়ে থাকা আকাশ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না। ‘এখন আমি কী করবো? রাস্তায় ভিক্ষা করবো?,’ প্রশ্ন করছিলেন আকাশ।
মানবজমিনকে আকাশ জানান, সেদিন পুলিশ আমাকে বলে আমি সহিংসতায় জড়িত এবং দোকানে লুকিয়ে আছি। কিন্তু দুই হাত জোড় করে বার বার বলেছি আমি দোকানে কাজ করি। আমি কোনো আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত না। আমি দোকান থেকে বাইরেও যাই নাই। কিন্তু পুলিশ আমার কোনো কথাই শোনে নাই। আমার বুক বরাবর বন্দুক তাক করে। আমি হাত দিয়ে সরিয়ে দিলে পুলিশ কাছ থেকে আমার বাম পায়ে গুলি করে। আমি নিরপরাধ, আমি কোনো অন্যায় করিনি। দোকানে কাজ করে খাই। বেতনের টাকা পরিবারকে দেই। আমাকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। কারণ আমি বাবা-মায়ের বড় ছেলে। আর্থিক সংকটে তেমন একটা লেখাপড়া করতে পারিনি। নিরুপায় হয়ে পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে মিষ্টির দোকানে কাজ নেই। আমি তো এখন পঙ্গু হয়ে গেলাম সারাজীবনের জন্য।
দোকান মালিকের ছেলে রাজু হোসেন বলেন, অত্যন্ত ভদ্র ও শান্ত একটা ছেলে আকাশ। আড়াই বছর ধরে আমাদের দোকানে কাজ করে। সে কোনো ধরনের আন্দোলন, বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত ছিল না।
কিন্তু পুলিশ এইসব কথা মানতে রাজি হয়নি। একজন আকাশের বাম হাঁটুতে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গেই মেঝেতে পড়ে যায় আকাশ। প্রচুর রক্ষক্ষরণ আর অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা আকাশকে বাঁচানোর জন্য আমরা তাকে প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করি। অনেক টাকা খরচ করেছি।
শনিবার বিকালে মানবজমিনকে আকাশের বাবা দুলাল মিয়া বলেন, ‘একটা বেসরকারি হাসপাতাল বলছিল দুই লাখ টাকা দিলে ছেলেটার পা বাঁচাতে পারবে তারা। কিন্তু তারা পারে নাই। পরে আকাশকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসি। ছেলেটার একটা পা কেটে ফেলতে হইছে।’
পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা দূর করার আশায় সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল আকাশের। তবে বন্দুকের একটা গুলি সেই স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে।
আকাশের বাবা আরও বলেন, ‘ধার দেনা করে এক লাখ টাকা নিয়ে আসছি। সেই টাকা ফুরিয়ে আসছে। সামনের দিনগুলোতে কী হবে তাও জানি না।’
দুলাল মিয়া জানান, ৪ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে আকাশ দ্বিতীয়। ছেলেদের মধ্যে সবার বড়। মিষ্টির দোকানে কাজ করে ছেলে সাড়ে ৭ হাজার টাকা বেতন পেতো। সব টাকাই বাড়িতে পাঠিয়ে দিতো। তার আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। আমি সরকারের কাছে আমার ছেলেকে একটা ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। যাতে সে তার জীবনটা বাঁচাতে পারে। একটা ভালো কৃত্রিম পা হলে আমার ছেলেটা আবার হাঁটতে পারবে।