‘আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই। দুনিয়ায় কারো কাছে বিচার চাই না।’ কথাগুলো বললেন কোটাসংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত একমাত্র সন্তান রিদওয়ান হোসেন সাগরের বাবা ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান। বললেন, ‘ছেলের রক্তের বিনিময়ে দেশে শান্তি বিরাজ করুক।’ গতকাল শনিবার ময়মনসিংহ নগরীর আকুয়া চৌরাঙ্গিরমোড় এলাকার বাসায় সাগরের শয়নকক্ষে বসে তিনি কথা বলছিলেন এই প্রতিবেদকের সাথে। জানালার পাশে টেবিলে সাগরের বইগুলো থরে থরে সাজানো। সাগরের বাবার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কাঁদতেও পারেন না। যেন কিছুই হয়নি। তিনি বলেন, ‘সব বাবা-মা সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। ভালো চাকরি করবে। ভালোভাবে জীবনযাপন করবে। কিন্তু সব কিছুই তো এলোমেলো হয়ে গেল।’ তিনি বলেন, ‘৩ নং পুলিশ ফাঁড়ির এক কর্মকর্তা মামলা করতে বলেছিলেন। আমি বলেছি মামলা করে কী হবে! মামলা করলে কী ছেলেকে দেখতে পাব! তিনি আমাকে জিডি করে রাখতে বললেন। আমি দুনিয়ার আদালতে ছেলে হত্যার বিচার চাইব না। তাই মামলা করিনি। পবিত্র জু’মার দিনে আল্লাহর ইচ্ছায় আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। আমি আল্লাহর কাছেই বিচার চাই।’
ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রিদওয়ান হোসেন সাগর (২৪) বাংলাদেশ আওয়ামী বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি লীগ ময়মনসিংহ মহানগর শাখার অর্ন্তগত ৬ নং ওয়ার্ড কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্নাতক তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষে চতুর্থ বর্ষে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হিসাব বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাগর তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা থাকায় লেখাপড়ার পাশাপাশি নগরীর এম এম কম্পিউটারে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। সাগরের বাবা বললেন, ‘ওতো (সাগর) খুবই নম্রভদ্র স্বভাবের ছিল। কারো সাথে বেয়াদবি করেনি। কারো দিকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলেনি। তার এমন মৃত্যুতে কষ্ট পাই, দুঃখ করি না।’ ‘সাগর হিসাববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও আইটিতে তার খুব দক্ষতা ছিল। ছেলেটা এভাবে চলে যাবে বুঝতে পারিনি। এক বছর আগে নতুন বাসা নির্মাণ করেছি। যার জন্য বাসা করেছি সেই তো আজ নেই। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিলে কে থাকবে এ বাসায়!’ ক্ষীণস্বরে আনমনে কথাগুলো বললেন সাগরের হতভাগ্য বাবা।
গত ১৯ জুলাই ময়মনসিংহ নগরীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সাথে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। মিন্টু কলেজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সাগর। সংঘর্ষে চারজন গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ৩৫ জন আহত হন। ওই দিন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: জাকিউল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সাগরের শরীরে বুলেটের আঘাত ছিল। তাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। সাগরের বাবা জানান, সাগরের বুকের বাম পাঁজরে একটি ছিদ্র ছিল। আর ডান দিকের নিচে পেটে বড় গর্ত ছিল। তাঁর ধারণা এটা গুলির আঘাতেই হয়েছে। তিনি আফসোস করে বললেন, ‘সাগর যাদের সাথে চলাফেরা করত, তাদের হাতেই নিহত হয়েছে। বলার কিছু নেই। আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।’
সাগর ও আফিয়া ভাইবোন। ছোট বোন আফিয়া তাবাসসুম সরকারি আনন্দ মোহন কলেজে ম্যানেজমেন্ট অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের মা রহিমা খাতুন আট বছর ধরে ক্যানসারে ভুগছেন। মৃত্যুপথযাত্রী সেই মা ছেলের মৃত্যুতে এখন বাকহারা। গত রোববার চেকআপ করতে যাওয়ার কথা ছিল। শুক্রবার ছেলের মৃত্যুতে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয়নি। গতকাল শনিবার শারীরিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হলে চেকআপ করতে নিয়ে যান স্বজনরা। ১৯ জুলাই জু’মা নামাজের পর দুপুরের খাবার খেয়ে সাগর মাকে বলে যান ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছি। বিকেলে সাগরের বাবা এক বন্ধুকে নিয়ে সাহেব কোয়ার্টার পার্কে যান। সন্ধ্যার পর প্রতিবেশী এক ছেলে সাগরের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দেন। বাসা থেকে ফোন করে তাকে দ্রুত বাসায় আসতে বললে তিনি (সাগরের বাবা) জানতে চান, কী হয়েছে। বলা হয়, সাগর গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তিনি হাসপাতালে ছুটে যান। হাসাপাতালের গেইটে পৌঁছে তিনি সাগরের লাশ দেখতে পান।