রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) দুই বছর ধরে এমআরআই মেশিন অচল হয়ে পড়ে আছে। একই অবস্থা সিটি স্ক্যান মেশিনের। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ অর্থোপেডিক ও ট্রমা হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিকল থাকায় রোগীরা চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে।
বাধ্য হয়ে অনেকে ছুটছে ‘পঙ্গু হাসপাতাল’ নামে সাধারণের কাছে পরিচিত এই হাসপাতালের পাশেই গড়ে ওঠা বিভিন্ন বেসরকারি চিকিৎসালয়ে।
এতে চিকিৎসা খরচ যেমন অনেক বেশি পড়ছে, তেমনি সব ক্ষেত্রে মানসম্মত সেবাও মিলছে না। গত কয়েক দিন গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালটির বহির্বিভাগ ও প্যাথলজি বিভাগের কর্মী ও রোগী এবং তাদের স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
হাড় ও মাংসপেশির সমস্যা পর্যবেক্ষণ করতে এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং) একটি নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা। অন্যদিকে রক্ত চলাচলে বাধাবিপত্তি, মস্তিষ্কসহ যেকোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ বা প্রদাহ নিরীক্ষণে প্রয়োজন সিটি স্ক্যান (কম্পিউটেড টমোগ্রাফি স্ক্যান)।
বিশেষ করে হাড়ভাঙাসহ দুর্ঘটনাজনিত বিভিন্ন আঘাতের নির্ভরযোগ্য পরীক্ষায় এ দুটি যন্ত্র অতি জরুরি।
১৪ জুলাই দুপুর ২টায় নিটোরের ১০৭ ও ১০৫ নম্বর কক্ষের সামনে গিয়ে দেখা যায় সুনসান পরিবেশ। অথচ দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ১০৭ নম্বর কক্ষে বহির্বিভাগের রোগীদের এক্স-রে করার কথা। ১০৫ নম্বর কক্ষে চোখ গেলে দেখা যায়, এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিনে ধুলার আস্তরণ।
কক্ষে দেখা গেল রাইসকুকার ও ফ্রিজ। ফ্রিজের ভেতরে সবজি ও মাংসও রাখা ছিল। দৃশ্যত, গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান এই যন্ত্রপাতির কক্ষটি অন্য কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একজন টেকনোলজিস্ট আসেন। জানতে চাইলে ওই কর্মী জানান, তিনি এখানকার টেকনোলজিস্টদের ইনচার্জ, নাম হুমায়ুন।
তিনি জানান, দুই বছর ধরে এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিন নষ্ট। মাঝে কয়েক দিনের জন্য ঠিক থাকলেও আবার নষ্ট হয়ে গেছে।
এর আগে গত ১০ জুলাই সকাল ১০টায় হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। সাধারণ রোগীরা নিয়ম মেনে লাইন ধরে টিকিট কাটলেও কিছুক্ষণ পর পর চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন কর্মচারীকে দেখা যায় লাইন টপকে টিকিট কাটতে। এ নিয়ে রোগীর স্বজন ও কর্মচারীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল। প্যাথলজি বিভাগে গিয়েও একই চিত্র চোখে পড়ে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে, অর্থের বিনিময়ে লাইনে দাঁড়ানোর সিরিয়াল এগিয়ে দিচ্ছেন কিছু কর্মচারী।
বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা গাজীপুরের আরিফুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে অপেক্ষা করছি। ডাক্তার নেই। এখন আড়াইটা বাজে, কী করব জানি না। কয়েক দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে, ওষুধ কিনতে হয়েছে। সব বাইরে থেকে। যে ট্রলিতে শুয়ে আছি, এর জন্যও টাকা দিতে হয়।’
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত চাঁদপুরের রহমত আলীর সঙ্গে থাকা স্ত্রী রোকসানা বললেন, ড্রেসিং করা ও খোলার জন্য প্রতিবার টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে এক্স-রে করার সিরিয়াল পাওয়া অতি কঠিন।
গত রবিবার দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে হাতে প্লাস্টার করা ছেলেকে নিয়ে বহির্বিভাগে আসেন এক মা। তিনি জানতে পারেন, ১১টার পর আর এক্স-রে করার জন্য কাউন্টারে টাকা জমা দেওয়া যায় না। ছেলেটির মা বলেন, তিনি একজন দায়িত্বরত আনসার সদস্যের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, যেভাবে হোক এক্স-রেটা করিয়ে দিন। তিনি তখন ২৫০ টাকার এক্স-রে ৫০০ টাকার বিনিময়ে করিয়ে দেন। আরো কয়েকজন রোগী ও স্বজনের কাছে অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা শোনা যায়।
হাতে প্লাস্টার করা সন্তানকে নিয়ে আসা ওই নারীর বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাইভেট হাসপাতালে এক্স-রে করালে তো আরো বেশি টাকা লাগত। এর সঙ্গে যাওয়া-আসার খরচ, সময়ের ব্যাপার আছে।’ সময়মতো বহির্বিভাগে চিকিৎসক না পাওয়ারও অভিযোগ করেন তিনি।
ওষুধ কম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য
নিটোরে ওষুধ কম্পানি প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্যেও অতিষ্ঠ রোগীরা। রোগী প্রেসক্রিপশন হাতে চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হলেই চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা। তাঁরা মোবাইলে প্রেসক্রিপশনের ছবিও তুলে নেন। অভিযোগ আছে, চিকিৎসক কোনো নির্দিষ্ট কম্পানির ওষুধ লিখেছেন কি না, তা তদারকি করেন তাঁরা।
সার্বিক বিষয়ে পরিচালক যা বললেন
গত বুধবার নিটোরের পরিচালক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এক বছরের কম সময় হয় এখানে পরিচালক হয়েছি। মেশিনগুলো নষ্ট হয়েছে আরো আগে। সমস্যার কারণ জানতে যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানকে জানিয়েছি। তারা হয়তো শিগগিরই জানাবে। পরিচালক আরো জানান, গত ১৪ জুলাই এমআরআই-সিটি স্ক্যান মেশিন চালু করার বিষয়ে বৈঠক হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে এগুলোর কী অবস্থা, তা জানা যাবে। তবে ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
হাসপাতালে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এমন অভিযোগ আগেও কয়েকবার এসেছে। আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। কিছুদিন পর পর দায়িত্বের জায়গা পরিবর্তন করছি। এখন যদি কেউ এমন করে থাকে, অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
কাজের বড় পরিধি ও সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে পরিচালক আরো বলেন, ‘১৭ কোটি মানুষের জন্য একটা মাত্র হাসপাতাল। কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। এক হাজার শয্যায় চিকিৎসা দেয়ার বাইরেও কয়েক শ রোগীকে অতিরিক্ত ভর্তি রাখা হচ্ছে। জরুরি বিভাগে দিনে আড়াই শ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে, বহির্বিভাগে এক হাজারের বেশি মানুষ সেবা নেয়।’
ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, ‘সারা দেশের রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা দিতে হলে অন্তত আমাদের বিভাগীয় শহরগুলোতে অর্থোপেডিক হাসপাতাল করতে হবে।’
https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/07/27/1409108
