আমাদের শিক্ষার হার নিয়ে অনেক চটকদার কথা বলা হলেও বাস্তবতার সাথে তা মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বাস্তবতা হচ্ছে কাজীর গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে শিক্ষার হার ছিল ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু দেশের সাক্ষরতার হার সম্পর্কে সরকারিভাবে যে পরিসংখ্যান প্রদান করা হয়, বাস্তবতায় বড় ধরনের শুভঙ্ককের ফাঁকি রয়েছে। সরকারের সাম্প্রতি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমাদের দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছিলেন তদানীন্তন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। সাক্ষরতা দিবস উদযাপনের তথ্য জানাতে সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান প্রতিমন্ত্রী। প্রতিমন্ত্রীর দেয়া তথ্যানুযায়ী এখনো দেশে ২৩ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। এই জনগোষ্ঠী সাত বছরের বেশি বয়সী। যা কোন জাতিরাষ্ট্রের জন্য সুখকর কোন খবর নয়। যদিও এই পরিসংখ্যানের মধ্যে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে বলে মনে করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বললেছন, সরকারি তথ্য মোতাবেক সার্বিকভাবে সাক্ষরতার হার বেশি হলেও প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার আরও কম। বিবিএসের প্রায়োগিক সাক্ষরতা জরিপ ২০২৩-এর তথ্য বলছে, ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের প্রায়োগিক সাক্ষরতা প্রায় ৭৩ শতাংশ। আর ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের এই হার ৭৩ দশমিক ৬৯। সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের পক্ষে জানানো হয়, তারা এ হার শতভাগ অর্জন করতে চান। ইউনেসকোর সঙ্গে মিল রেখে গত বছরের বাংলাদেশে সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয় ‘পরিবর্তনশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সাক্ষরতার প্রসার’। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের কোন আহামরি অর্জন নেই বরং সবকিছুই সীমাবদ্ধ থেকেছে কথামালার ফুলঝুড়ির বৃত্তেই। তাই আমাদের সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, দেশে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিতে গত কয়েক দশকে সরকারিভাবে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এ নিয়ে দেশী-বিদেশী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে অনেক প্রকল্প ও কর্মসূচি। এসব প্রকল্পের অগ্রগতি আশানুরূপ বলে বিভিন্ন সময় দাবিও করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে খাজনার চেয়ে বাজনায় হয়েছে বেশি। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর ন্যাশনাল রিপোর্টের অধীন আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩-এর তথ্য বলছে, দেশের ১৮টি জেলায় এখনো ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ লিখতে বা পড়তে পারেন না। এমনকি অতীতে নিরক্ষরতামুক্ত হিসেবে ঘোষিত জেলাও এ তালিকায় রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রীতিমত বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। আর এটিকে রীতিমত আত্মপ্রবঞ্চনা বলেই মনে করছেন আত্মসচেতন মহল।
নিরক্ষরতার হারের দিকে গোটা বাংলাদেশে শীর্ষে পার্বত্য জেলা বান্দরবান। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, জেলাটিতে নিরক্ষরতার হার ৩৪ দশমিক ১০ শতাংশ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দুর্গম জেলাটিতে জনসংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও এর পুরোটাকে সর্বজনীন শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয় নি। যদিও জেলাটিতে অনেকগুলো সরকারি-বেসরকারি স্কুল রয়েছে। গত কয়েক দশকে এখানে সাক্ষরতার হার বাড়ানোর তাগিদে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নেয়া হয়েছে অনেক কর্মসূচি। যদিও এখনো জেলার এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ অক্ষরজ্ঞানহীন রয়ে গেছেন। সরকারি-বেসরকারি কোন উদ্যোগই এক্ষেত্রে আহামরি কোন সাফল্য দেখাতে পারে নি। ফলে পার্বত্য বান্দরবান জেলার সাক্ষরতার হার বাড়ানো সম্ভব হয় নি বরং অতীতে যে পরিসংখ্যান প্রদান করা হয়েছে তাও সর্বাংশে বস্তুনিষ্ঠ নয়।
এক্ষেত্রে দারিদ্র্য বড় একটি ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিবিএসের সর্বশেষ কয়েকটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হারের দিক থেকে শীর্ষে থাকা জেলাগুলোর অন্যতম বান্দরবান। সংস্থাটির ২০১৬ সালের জরিপেও দারিদ্র্যের হারের দিক থেকে দেশে বান্দরবানের অবস্থান ছিল তৃতীয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) গৃহীত এক প্রকল্পের তথ্যে জানানো হয়, বাংলাদেশে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি বান্দরবানে, যার হার ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ।
দারিদ্র্যের পাশাপাশি অবকাঠামো ও জনবল ঘাটতি, মাঠপর্যায়ের দুর্বলতা এবং সমন্বয়হীনতার কারণেও এখানে অনেক সময় আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বান্দরবান জেলায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো সূত্র বলছে, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পরিকল্পনা করা হচ্ছে, উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে; তবে সবসময় কাক্সিক্ষত ফলাফল আসছে না। বিশেষত যখন বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে, তখন অনেক ক্ষেত্রেই তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। ফলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা যাচ্ছে না। এছাড়া অনেক সময় লোকবল ও অর্থের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।’ তবে এক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নিরক্ষরতার হারে দ্বিতীয় অবস্থানে ময়মনসিংহ বিভাগের দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা জামালপুর। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এ জেলার প্রতিটি উপজেলায় দারিদ্র্যের হার বেশি। পাশাপাশি নদী ভাঙনপ্রবণ এলাকাটির শিক্ষা অবকাঠামোও খুবই দুর্বল ও অপ্রতুল। এখানকার অনেকগুলো স্কুলই চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়া। আবার এমনও স্কুলের খবর পাওয়া যায়, যেখানে শিক্ষকের সংখ্যা ১ জন। দুর্বল শিক্ষা অবকাঠামো ও দারিদ্র্যের কারণে জেলার বাসিন্দাদের নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজও খুব একটা এগোনো যায় নি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ বাসিন্দারই অক্ষরজ্ঞান নেই।
জামালপুর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ‘এ এলাকায় সাক্ষরতার হার কম হওয়ার একটা বড় কারণ দারিদ্র্য। নদীভাঙনপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় এখানে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে এবং শিক্ষার প্রতিও আগ্রহ কম। এছাড়া আউট অব স্কুল চিলড্রেন কার্যক্রম বা এ ধরনের উদ্যোগগুলো সব উপজেলায় চলমান নেই।’ একই ধরনের সংকট ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলায়ও। এ দুই জেলা এখন নিরক্ষরতার হারের দিক থেকে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে। এ দুই জেলায় নিরক্ষরতার হার যথাক্রমে ৩১ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ৩০ দশমিক ৮০ শতাংশ।
শেরপুর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো সংশ্লিষ্টরা জেলাগুলোর পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে দায়ী করছেন জনবল সংকট ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে ধীরগতিকে। গণমাধ্যমকে তারা বলেছেন, ‘এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব দেয়া হয় এবং দেখা যায় এক-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। এর একটি প্রভাব সামগ্রিকভাবেই দেখা যায়। এছাড়া জনবল সংকটসহ আরো বেশকিছু বিষয়ও সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নকে ধীরগতির করে দেয়।’
উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা কুড়িগ্রাম নিরক্ষরতার হারে সারা দেশে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। জেলার নয় উপজেলার সবগুলোয়ই উচ্চমাত্রায় দারিদ্র্য বিরাজমান। এখানকার অনেক এলাকায় বিশেষ করে চরাঞ্চলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই বেশ করুণ দশা। এমনকি কোনো কোনো চরে দু’টি বেঞ্চ, সাইনবোর্ড আর তিন শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুল পরিচালনারও নজির রয়েছে।
দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকাগুলোয় সাক্ষরতার হার বাড়াতে সরকারি উপবৃত্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তার বক্তব্য হলো, দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীদের যে উপবৃত্তি দেয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। সম্প্রতি যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল, তাদের অকৃতকার্য হওয়ার কারণগুলোও শোনা হয়েছিল যত্ম সহকারে। সেখানেও সবাই উপবৃত্তি অন্তত ৫০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে এটি আসলেই জরুরি। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
জাতীয় সাক্ষরতা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘বর্তমানে সাক্ষরতার হারে যে প্রভাব দেখা যাচ্ছে সেটি মূলত স্কুলগামী শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পাওয়ায়। কিন্তু আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির জন্য অনেকদিন কোনো বৃহৎ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। যেগুলো নেয়া হচ্ছে সেগুলো বিভিন্ন প্রকল্প এবং প্রকল্পের মেয়াদ শেষে তেমন কার্যকারিতা থাকছে না। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির জন্য বৃহৎ কর্মসূচি দরকার, প্রাথমিক শিক্ষার মান নিশ্চিত করা দরকার। এখন দেখা যাচ্ছে একজন শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ছে কিন্তু সে ঠিকভাবে বাংলাও পড়তে পারছে না। এমনটি যেন না হয়। আর এ বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষায় প্রকৃত বরাদ্দ বা জিডিপির বিপরীতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং অর্থের সঠিক ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে।’
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অন্যান্য জেলার মধ্যে গাইবান্ধা ও মেহেরপুরে ২৯ শতাংশের বেশি, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় ২৮ শতাংশের বেশি, মানিকগঞ্জ, ভোলা, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জে ২৬ শতাংশের বেশি এবং রাঙ্গামাটি, ময়মনসিংহ, রংপুর ও ঝিনাইদহে ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ নিরক্ষর। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গাকে সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে নব্বইয়ের দশকেই নিরক্ষরমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে শিক্ষায় বিনিয়োগ ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি জরুরি। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এখন সাক্ষরতা বলতে শুধু স্বাক্ষর করতে পারাকে বোঝানো হয় না। আরো কিছু দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত। আর শিক্ষা একটি চলমান চর্চার বিষয়। দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে কয়েকটি বিষয় জরুরি। প্রথম, দেশে শতভাগ শিশুর স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে। এটি শুধু কাগজে-কলমে নয় প্রকৃত অর্থেই নিশ্চিত করতে হবে; দ্বিতীয়ত, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিযা চালু রাখতে হবে; তৃতীয়ত, বয়স্ক শিক্ষা চালু রাখতে হবে এবং চতুর্থত, যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হবে।’
১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সবার জন্য শিক্ষা সম্মেলনে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়। পরে সাক্ষরতা বিস্তারে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সার্বিক সাক্ষরতা কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে সাক্ষরতা কর্মসূচিতে একটি সামাজি আন্দোলনে পরিণত করা হয়। এ সময় দেশের সাতটি জেলাকে নিরক্ষরমুক্ত হিসেবেও ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে দেশের ৬৪ জেলায় মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে পিইডিপি-৪-এর আওতায় চলমান রয়েছে আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রকল্প। এছাড়া সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে আরো বেশকিছু প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু এতোকিছু করার পর দেশের সাক্ষরতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না বরং সরকারিভাবে যে সাক্ষরতার পরিসংখ্যান প্রদান করা হচ্ছে সেখানেও বড় ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি সংজ্ঞা অনুযায়ী, সাক্ষরতা বলতে এখন শুধু অক্ষরজ্ঞান বা স্বাক্ষর করতে পারা বোঝানো হয় না। সাক্ষরতা বলতে বাংলা পড়তে পারা, মৌখিকভাবে ও লিখিতভাবে বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করতে পারা, যোগাযোগ স্থাপন করতে পারা এবং গণনা করতে পারা বোঝায়। তবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণা বলছে, অনেক শিক্ষার্থী স্কুলগামী হলেও তারা সঠিকভাবে পড়তে ও গণনা করতে শিখছে না। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীর প্রাক-প্রাথমিকেই বাংলা বর্ণমালা ও গণিতের ১ থেকে ২০ পর্যন্ত শিখে ফেলার কথা। প্রতিবেদন অনুযায়ি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অনেক শিক্ষার্থীরই বাংলা বর্ণ ও গণিতের সংখ্যা চিনতে সমস্যা হয়।
এডুকেশন ওয়াচের এক প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘সাক্ষরতার হার নিশ্চিতে সব শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি নিরক্ষর বয়স্কদেরও সাক্ষরতা জ্ঞান প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায় তারা চিন্তা করেন, এখন আর শিখে কী হবে। এ চিন্তাটা দূর করতে হবে। এছাড়া সাক্ষরতা মানে শুধু স্বাক্ষর করতে শেখানো নয়, তাহলে দেখা যাবে আজকে যাকে সাক্ষরতা জ্ঞান দেয়া হলো সে কয়েক বছর পর আবারো ভুলে যাবে। এ কারণে চর্চার মধ্যে রাখতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এসব বিষয়ে যারা দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে হবে। কোথাও ঘাটতি পাওয়া গেলে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের নাগরিকদের মধ্যে ৭৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ লিখতে ও পড়তে পারেন। এ বয়সীদের মধ্যে ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ পড়তে পারেন। আর ২০ দশমিক ৩৭ শতাংশ মানুষ লিখতে বা পড়তে কোনোটিই পারেন না।
বর্তমানে প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অধীনে দেশের ৬২টি জেলায় আউট অব স্কুল চিলড্রেন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ কার্যক্রমের অধীনে স্কুলের বাইরে থাকা ৮-১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে শতাধিক এনজিও কাজ করছে। তবে এরই মধ্যে এ প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সংশয় প্রকাশ করেছে। তাই এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম।
পিইডিপি-৪-এর পক্ষে বলা হয়েছে, ‘সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতে সরকার বেশকিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে এবং পিইডিপি-৫-এ আরো বৃহৎ কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এছাড়া আমরা এখন সাক্ষরতা বলতে শুধু পড়তে এবং লিখতে শেখানো নয় বরং প্রত্যেককে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে ভাবছি। এরই মধ্যে কক্সবাজারে এ বিষয়ে একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে। এটি সফল হলে দেশব্যাপী এ ধরনের কার্যক্রম শুরু হবে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র দাবি করেছে, ‘আগে আমাদের বিভিন্ন প্রকল্প চলমান থাকলেও দেশে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিতে এখন আমরা স্থায়ি কর্মসূচিতে যাচ্ছি। এরই মধ্যে দেশের প্রত্যেক উপজেলায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার অধীনে লার্নিং সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। আশা করছি এ অর্থ বছর থেকে আমরা এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারব। এটি করা হলে দেশে শতভাগ মানুষের সাক্ষরতা নিশ্চিত করা অনেকাংশে সহজ হবে।’ কিন্তু সরকারের এমন দাবির সাথে বাস্তবতার তেমন কোন মিল খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।
মূলত, যে জাতি যত উন্নত, সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা ততই মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। জাতিকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখে কোন জাতিই সামনের দিকে এগুতে পারেনি। তাই একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদেরকে শতভাগ সাক্ষরতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা জরুরি হলেও এক্ষেত্রে আমারা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ি দেশে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮ হলেও বাস্তবতা কিন্তু এই দাবির সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এমনকি যেসব জেলাকে শতভাগ সাক্ষরতা লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়, সেসব জেলার তথ্যে বড় ধরনের ঘাপলা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এমতাবস্থায় জাতীয় সাক্ষরতা নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল না খেলে আমাদেরকে অবশ্যই বাস্তবমুখী হতে হবে। জাতিকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার কোন প্রয়োজন নেই। শতভাগ সাক্ষরতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন অপোষ করলেও চলবে না বরং যেকোন মূল্যে এই অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দও সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। জাতিকে সাক্ষরতাহীন রেখে কোন জাতিই সামনে দিকে এগুতে পারে না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলদ্ধি করবেন ততই মঙ্গল।