॥ গতকালের পর ॥
গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় শিক্ষা: আশুরা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে এবং মুসলিমদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও প্রেরণা যোগায়। ইসলামী গবেষকগণ এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণের নসিহত করেন।
১. আধিপত্যবাদ, অসত্য ও অন্যায়ের সামনে মাথা না করা: একজন মুমিন কোন অবস্থায়ই আধিপত্যবাদ, অসত্য ও অন্যায়ের সামনে মাথা নত করবে না, প্রয়োজনে জীবন দিয়ে অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে শহিদ হওয়া অব্দি সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
২. মায়া কান্না, কেবলমাত্র চোখের পানি ও আবেগের কোনো মূল্য নেই ইসলামের জন্য চোখের পানি ফেলা, দোয়া করা, সুললিত কন্ঠে ইসলামী নেতৃত্ব বা ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করা খুবই সহজ কাজ। কিন্তু তা ইসলামের জন্য কোন বড় প্রয়োজনে আসেনা। বরং এসব কাজ যারা করে, তারা ইসলামের প্রকৃত প্রয়োজনের সময় কোন ভূমিকা রাখেনা বা রাখতে পারেনা। তাই চোখের পানির চেয়ে কাজটাই বড়, যদিও তা হয় অতিক্ষুদ্র।
১. দ্বীনে হক-ন্যায় ও সত্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ইমাম হুসাইন তার জীবন দিয়ে দ্বীনে হক-ন্যায় ও সত্যের প্রতি তার প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা প্রমাণ করেছিলেন। তার এই আপোষহীন সংগ্রাম কেয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রেরণার উৎস।
২. দ্বীনে হকের পক্ষে সর্বোচ্চ কুরবানি পেশ-ইমাম হোসাইন (রা.) আল্লাহ তায়ালা এবং মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনা মোতাবেক দীনে হক প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ কুরবানির নজরানা রেখেছেন। তিনি অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্য সর্বোচ্চ কুরবানি করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালার বাণী: “তোমরা সর্বত্র আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এবং ফিতনা-ফাসাদ, দুর্নীতি, অপরাধ, সন্ত্রাস ইত্যাদি চিরতরে নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত লড়াই, সংগ্রাম এবং প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখো। সূরা আল বাকারাহ : ১৯৩
৩. বিপদে দৃঢ়তা, সবর ও অনঢ় থাকা : ইমাম হুসাইন (রা.)কে কারবালার যুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ, আক্রমণ ও বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অনাকাক্সিক্ষত ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, বাধা, প্রতিরোধ ও আসন্ন বিপদের মুখেও তিনি জিহাদের ময়দানে অনড়, অটল ও দৃঢ় চিত্ত ছিলেন। বিশ্ব নবীর (সা.) কলিজার টুকরা ইমাম হোসাইন আমাদেরকে শিখিয়ে গেলেন কঠিন বিপদের মুখে-জিহাদের ময়দানে অনড় মনোবল নিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। তিনি আল্লাহ তায়ালার ওই বিধানই সপরিবারে সঙ্গী সাথীদের নিয়ে প্রমাণ করলেন “ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো যখনই ইসলামের দুশমন শত্রুদের দলের সামনাসামনি হবে, খবরদার সেখান থেকে কোনক্রমে পিছিয়ে হটবে না।” -সূরা আনফাল : ১৮
৪. মুক্তি, শান্তি ও সদাচরণের দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের সূযোগ: ইমাম হুসাইনের (রা.) শহীদ হওয়ার বিষয়টি মুসলিমদের মধ্যে মুক্তি, শান্তি ও সদাচরণের দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত করে। এটি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রেম ও সহানুভূতি বাড়াতে সহায়তা করে।
৫. ন্যায়পরায়ণতা ও ধৈর্যের মূল্য : ইমাম হুসাইন তাদের বিপরীত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্য তাদের প্রাণত্যাগ করেছিলেন। এটি আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, ধৈর্য ও ন্যায়পরায়ণতা জয়ের চাবিকাঠি।
৬. আত্মত্যাগ ও পরোপকারিতার মূল্য : শোহাদায়ে কারবালা ও আশুরার ঘটনায় আমরা আত্মত্যাগ ও পরপোকারিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করি।
৭. মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও শান্তির প্রতীক: হুসাইনের নৈতিক বীরত্ব ও শহীদ হওয়া তাদের বিশ্বাস, জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক চেতনার অংশ হয়ে গেছে। হুসাইনের প্রতিবাদ জন্য কৃতজ্ঞতার বিষয় এবং ইসলামিক বিশ্বের ঐক্য ও শান্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে আছে।
৮. হুসাইনের প্রতিবাদ ইসলামের শক্তি ও মর্যাদাকে প্রতিফলিত করে। তা ইসলামের শান্তিময় বার্তা প্রচার করতে সহায়তা করে।
৯. হুসাইনের শাহাদাত, আত্মত্যাগ ও ধৈর্যের মাধ্যমে ইসলামের অহিংস মূল্যবোধকে উজ্জ্বল করে তোলে। এটি সকল মুসলিম ভাইদের মধ্যে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের ভাবনাকে জাগ্রত রাখতে সহায়তা করে।
১০. সভ্যতা ও মানবতার পরাজয়: ইমাম হুসাইনের বিরুদ্ধে যে অবিচার, নৃশংসতা ও অত্যাচার হয়েছে তার প্রতিবাদ না করলে মানবতার পরাজয় হবে। বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (রা.) এর লাশের সাথে যে অ-সৌজন্যমুলক আচরণ করা হয়েছে তা মানব সভ্যতাকে বিলীন করেছে।
১১. ইমাম হোসাইনের শহীদ হওয়ার স্মরণ : আশুরা উৎসবে ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের কারবালার যুদ্ধে শহীদ হওয়ার স্মরণ করা হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত।
১২. ক্ষমা ও ত্যাগের শিক্ষা : ইমাম হোসাইনের জীবন ও শহীদ হওয়ার ঘটনা মুসলিমদের অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে এবং প্রয়োজনে নিজের প্রাণ বাজি রাখতে উৎসাহিত করে।
১৩. সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতি : ইমাম হোসাইন ও তার পরিবারের পরিণতি সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তা ও অধিকারের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করে।
১৪. সহমর্মিতা ও ভালবাসার শিক্ষা : আশুরার ঘটনায় ইমাম হোসাইনের পরিবার প্রতিবন্ধকতার মুখে থাকা ও তাদের প্রতি যে সহযোগিতা ও ভালবাসা প্রদর্শন করা হয়েছিলো তা মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়।
১৫. ধর্মীয় একাত্মতা : আশুরা উৎসব সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় একাত্মতা ও সংঘবদ্ধতা প্রকাশ পায়।
উপসংহার : আশুরা ও ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনা অত্যন্ত বেদনা বিধুর-দুঃখজনক ট্রাজেডি। এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে সত্য মিথ্যা পার্থক্যের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। এর উপর ভিত্তি করে ইসলামের প্রথম যুগের সাহাবী ও তাবেয়ীগণকে কাফির আখ্যায়িত করা যাবে না। ইসলামী মনীষীদের মতে ইমাম হোসাইন (রা.) ইজতিহাদ করে কোনো গুনাহ করেননি। আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আমাদের ঈমানেরই অংশ। অপরদিকে সাহাবী তাবেয়ীদেরকে কাফির আখ্যায়িত করা স্পষ্টতই কুফরি ও বিভ্রান্তি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আশুরা ও কারবালার শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে সাচ্চা ঈমানদার হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। (সমাপ্ত)
