১৬ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার

নিষ্পত্তিকৃত ইস্যু নিয়ে খেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেনশন

-ড. মো. নূরুল আমিন

গত সপ্তাহে এই স্তম্ভে কোটা সংকট নিয়ে আলোচনা করেছিলাম এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, বারান্তে পেনশন নিয়ে কিছুটা কথা বার্তা বলবো। বলেছিলাম ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত সার্বজনীন পেনশন স্কীম বিরোধী আন্দোলনের ফলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। আশা করেছিলাম সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে সরকার অবশ্যই ইস্যুগুলোর গ্রহণযোগ্য সমাধান করবেন। দুর্ভাগ্যবশত এর মধ্যে তা হয়নি। দেশব্যাপী প্রবল বর্ষণজনিত বন্যা, রাজধানীসহ বৃহৎ শহরগুলোর জলাবদ্ধতা প্রভৃতির ফলে পরিবেশ সরকারের কিছুটা অনুকূলে আসলেও আন্দোলন থামেনি। সরকারের মধ্যে বিচলিত হবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অবস্থাটা সপ্তদশ শতকের বৃটিশ রাজনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তৎকালীন বৃটিশ সরকারের কিছু কিছু পদক্ষেপে ঐ দেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল কিন্তু তাদের বিক্ষোভ সরকারের টনক নড়াতে পারেনি। এই অবস্থায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও অদক্ষতাকে উপলক্ষ করে একজন কবি, আমার যদ্দূর মনে পড়ে স্টেনলি লেইনপুল একটি রম্য-কবিতা লিখেছিলেন।

কবিতাটি হচ্ছে :
When movements move they let them move When Prolems rage they let them rage And thus ignore the spirit of the age

বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অবস্থাও অনেকটা তাই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ সরকারের নিয়ন্ত্রক হয়। সরকার জনগণকে ভয় করে। তাদের চাহিদা পূরণ ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়। কেননা প্রতি ৪/৫ বছর পর পরই ভোটের জন্য জনগণের দ্বারস্থ হতে হয়, কিন্তু যেখানে সরকার প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগকে কব্জা করে দেশ চালায় সেখানে জনগণের চাহিদা ও মতামতের মূল্য দেওয়া হয় না।

এখন পেনশন প্রসঙ্গে আসি। পেনশন বা অবসর ভাতার বিধান প্রণয়ন নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য একটি বিরাট কৃতিত্ব।
জার্মানীর চ্যান্সেলার অট্টো ভন রিসমার্কের শাসনামলে ১৮৮৯ সালে জার্মান রিসট্যাগ বা পার্লামেন্টে সর্বপ্রথম আইন করে অবসর ভাতার প্রবর্তন করা হয়। এটা ছিল সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য একটি বিরাট তোহফা এবং সাথে সাথে অল্প বয়সীদের জন্য একটি উদ্দীপনারও বিষয়। ঐ সময় ঠিক হয় যে, ৭০ বছর চাকরির পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারী অবসর গ্রহণ করবেন এবং এই সময়ে তাকে এককালীন একটা অংক আনুতোষিক হিসাবে নগদ প্রদান করা হবে যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার অবসরকালীন সময়ে-ভরণ পোষণ ও চিকিৎসা চাহিদাসহ জীবনযাত্রার অর্জিত মান বজায় রাখতে পারে। এই এককালীন আনুতোষিক ব্যবস্থা পরে আনুতোষিক (এককালীন) ও মাসিক ভিত্তিতে ভাতা প্রদান ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। ঐ সময়ে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৫ বছর। দুই বিশ^যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শিল্পোন্নত দেশগুলো বিশেষ করে ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে ১৯৩০ ও ১৯৩৫ সালে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য বীমা প্রথা চালু করেন। পরবর্তীকালে এই ব্যবস্থাটি সর্বস্তরের জনগণের জন্য সম্প্রসারণ করা হয়।

কর্মজীবনের লাইফ স্টাইল কিভাবে বৃদ্ধ বয়সেও বজায় রাখা যায় তা নিয়ে অনেক বিতর্কের পর বৃদ্ধ বয়সের বেতন স্থিরিকৃত হয় এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রতিবছর এই বেতন বা ভাতা সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সারা দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশেই নগদ পেনশন ও স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। আমরাও এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছি। এজন্য যা করতে হয় সরকারই করেন, বীমা কোম্পানীগুলোও করে। কোনও ব্যক্তিকে মাসে মাসে চাঁদা দিতে হয় না, গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম আঞ্জাম দেয়ার দায়িত্বও তার নয়, সে সুবিধাভোগীই মাত্র।

অর্ধ শতাব্দি ধরে আমাদের দেশেও এই ব্যবস্থা চলে আসছে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি করেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে শত ভাগ পেনশন সমর্পণকারী কর্মচারীদের অবসরের ১৫ বছর পূর্তির পর সরকার পুনঃমাসিক পেনশন ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু কার্যত সকল ক্ষেত্রে তারা তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। বাছাই করা কিছু সরকারি সংস্থার বেলায় তা কার্যকর হলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে রাজস্ব বাজেটভুক্ত বহু স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সেবা সংস্থার কর্মকতা কর্মচারীদের এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে মামলাও চলছে।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আগে পেনশনভোগী ছিলেন না। তাদেরকে পেনশনের আওতায় এনে সরকার একটি ভাল কাজ করেছেন। তাদের পেনশনের বিষয়টি মীমাংসিত ছিল। কিন্তু হঠাৎ সরকার এই মীমাংসিত বিষয়টি বিতর্কিত করে ফেললেন, তাও সার্বজনীন পেনশনের নামে। সার্বজনীন তাকেই বলে যা সার্বজনগ্রাহ্য Universal Pension Scheme বলতে ঐ স্কীমকেই আমরা বুঝি যা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও অনুসরণ করে। সব দেশ না হলেও অন্তত: অধিকাংশ দেশ। আমি এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার অনেকগুলো দেশের খবর নিয়েছি। তারা কেউই বাংলাদেশের মত এরকম আজব পেনশন স্বীম বাস্তবায়ন করে না। আমাদের সার্বজনীন স্কীমে বিভিন্ন শ্রেণী মানুষের জন্য প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রত্যয় নামে কতগুলো পেনশন প্রকল্প খোলা হয়েছে। সরকারী আধা সরকারী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কীমে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এই প্রকল্পগুলোর অধীনে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা ১০ থেকে ৪২ বছর পর্যন্ত নিদিষ্ট হারে মাসিক চাদা জমা দিয়ে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক পেনশন ভোগ করবেন। চাঁদার মাসিক হার হচ্ছে ১০০০.০০, ২০০০.০০, ৩০০০.০০ ও ৫০০০.০০ টাকা পর্যন্ত ৪২ বছর ধরে যারা মাসিক চাঁদা দিবেন মেয়াদেন্ত তারা পাবেন মাসিক সর্বনিম্ন ৩৪৪৬৫ টাকা এবং সর্Ÿোচ্চ ১,৭২,৩২৭ টাকা। ৪০ বছর বছর যারা চাদা দিবেন তারা পাবেন সবনিম্ন মাসিক ২৯,২০০ টাকা ও সর্বোচ্চ পাবেন ১,৪৬,০০১ টাকা, ৩৫ বছর যারা চাদা দিবেন তারা পাবেন সবনিম্ন ১৯,১২৭ টাকা ও সর্বোচ্চ ৯৫,৯৩৫.০০, টাকা। ২০ বছর মেয়াদীরা সর্বনিম্ন ৪৯২৭ টাকা, সর্বোচ্চ ২৪,৬০৪ টাকা এবং ১০ বছর মেয়াদীরা যথাক্রমে মাসিক ১৫৩০ টাকা ও ৭৬৫১ টাকা। বিদ্যমান ব্যবস্থায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতনের আশি শতাংশকে পেনশন উপযোগী বলে গণ্য করা হয় এবং এর ৫০ শতাংশ টাকা প্রতি ২০০ টাকা, কোন কোন ক্ষেত্রে তার বেশি দিয়ে যে অংক আসে তা এককালীন আনুতোষিক হিসেবে প্রদান করা হয় এবং মূল বেতনের ৮০ শতাংশ মাসিক পেনশন হিসাবে প্রদান করা হয়। এখানে পারিবারিক পেনশনেরও ব্যবস্থা আছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের বর্তমান যে পে স্কেল তাকে বিবেচনা করলে আনুতোষিক হিসাবে তিনি অবসরের প্রাক্লালে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা পাওয়ার কথা। তার মাসিক পেনশনের পরিমান হবে ৫০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে। তিনি মারা গেলে তার স্ত্রী আজীবন পেনশন সুবিধা পান। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় আনুতোষিক ও পারিবারিক পেনশনরে ব্যাপারে কোনও বক্তব্য নেই। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমে সরকারের অবিমৃষ্যকারিতাকেই জাতির সামনে তুলে ধরেছেন বলে মনে হয়। শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে সরকারি কর্মচারীরাও এতে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০২৩ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সরকার কর্তৃক বাধ্যতামূলক করে গেজেট বিজ্ঞপ্তি না দেয়া পর্যন্ত এই স্কীমে অংশগ্রহণ ঐচ্ছিক থাকলেও রোববার এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে ২০২৫ সাল থেকে প্রত্যয় স্কীম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

একটি মীমাংসিত ও নিষ্পত্তিকৃত বিষয়কে পরিবর্তন করে এই অস্থিরতা সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে অনেকেই দেশে টাকার সংকট পূরণের জন্য একে সরকারের একটি প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন। পেনশন স্কীমের নামে সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সরকার টাকা সংগ্রহ করতে চান। ব্যাংকগুলো নগদ টাকার চাহিদা পূরণ করতে পারছে না, চেক ভাঙ্গাতে গিয়ে মানুষকে হয়রানির স্বীকার হতে হয়। মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনতে চাচ্ছে না। ডলার বাঁচানোর জন্য আমদানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে পেনশনের নামে চাঁদাবাজিকে অনেকেই একটা ধান্ধাবাজি বলেই গণ্য করেন।

সরকার বলছেন, আমরা অনেক উন্নতি করেছি, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। দাবিটি কতটুকু সত্য তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়। উন্নয়ন শাস্ত্র অনুযায়ী বিত্ত-বৈভব ও সম্পদ বৃদ্ধির নাম প্রবৃদ্ধি। প্রবৃদ্ধির সাথে নীতি ও সুশাসন যোগ করলে হয় উন্নতি। এই উন্নতির সাথে নৈতিকতা, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতা যোগ হলে হয় সাফল্য। গত অর্ধশতাব্দীতে আমরা এই সাফল্য কতটুকু অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি? ঝুলন্ত ও পরিবর্তনশীল নীতি পলিসি, মীমাংসিত বিষয় নিয়ে খেলা এবং বাস্তব অবস্থাকে উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে উপমহাদেশের একজন শাসক ‘পাগলা রাজা’র খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন মোহাম্মদ বিন তুঘলক, ভারতবর্ষের তুঘলক বংশের দ্বিতীয় সুলতান, সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের পুত্র। তিনি সুশিক্ষিত, সৎ এবং সদাচারী একজন শাসক ছিলেন। সিংহাসনে আরোহণ করার পর তার গৃহীত পদক্ষেপগুলো শুধু বিতর্কেরই সৃষ্টি করেনি, জনদুর্ভোগেরও কারণ হয়েছিল। দোয়াব ও কাঙ্গরা অভিযান তার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। তিনি রাজধানী দিল্লী থেকে দৌলতাবাদে স্থানান্তর করেছিলেন এই যুক্তিতে যে, ঐ স্থানটি সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিল। কিন্তু আবহাওয়া তাকে পুনরায় দিল্লীতে রাজধানী ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেছিল। কথিত আছে যে, তিনি একবার কনৌজের সব বাসিন্দাদের হত্যা করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং এই নির্দেশ প্রত্যাহারও করেছিলেন।
তিনি রূপার তংকার পরিবর্তে তাম্র মুদ্রা চালুর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার নির্মিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে জাহানপানা নগরী ও আদিলাবাদ দুর্গ প্রসিদ্ধ। বলাবাহুল্য মহারাষ্ট্রের দৌলতাবাদ দুর্গটি বর্তমানে দেবগীরি দুর্গ নামে পরিচিত। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বলেছেন, ‘তার চিন্তাধারা ও অভিপ্রায় মহৎ ছিল কিন্তু তার এই অভিপ্রায়গুলো জনগণের বোধগম্য ছিল না। এ কারণেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।’
আমাদের শাসকদের আমরা তার সাথে কি তুলনা করতে পারি?

https://www.dailysangram.info/post/561398