এই মুহূর্তে দেশে তিনটি বড় ইস্যু দেশকে প্রবলভাবে আলোড়িত করছে। একটি হলো, ভারতকে রেল করিডোর প্রদান। দ্বিতীয়টি হলো সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, যেটি অতি সাম্প্রতিককালে প্রাক্তন আইজিপি বেনজির আহমেদকে দিয়ে শুরু হয়েছিল। তারপর দেখা গেল, বেনজির তো Tip of the iceberg. অর্থাৎ বিশাল একটি হিমবাহের ওপরের অংশটুকু মাত্র। তারপর একে একে অনেকের নাম এসেছে এবং এখনও আসছে। তৃতীয়ত ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। আরেকটি বিষয় সর্বশেষে যুক্ত হয়েছে। সেটি হলো প্রধানমন্ত্রীর সদ্য সমাপ্ত চীন সফর। চারটি বিষয় একসঙ্গে আলোচনা করা সম্ভব হবে না। আজ এই কলামে দুটি বিষয় আলোচনার চেষ্টা করবো। একটি হলো ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলন। আরেকটি হলো প্রধানমন্ত্রীর সদ্য সমাপ্ত চীন সফর। প্রথমে শুরু করছি কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে। এই লেখাটি লিখছি বৃহস্পতিবার ১১ জুলাই।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তের খবর দেশবাসী জানার চেষ্টা করছেন। বলতে গেলে সমগ্র দেশবাসী টেলিভিশন, রেডিও এবং পত্রপত্রিকার অনলাইন সংস্করণ এবং নিউজ পোর্টালগুলোতে চোখ রাখছেন। এই লেখাটি লিখছি বৃহস্পতিবার বিকাল ৫ টা থেকে। আমি দুই-তিনটি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ দেখলাম। বিকাল সাড়ে ৫টাতেও শাহবাগ মোড়ে একদিকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এবং অন্যদিকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ মুখোমুখি। সর্বশেষ পরিস্থিতি কী হবে এই মুহূর্তে তা ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে রোববার যখন আপনারা এই কলাম পড়বেন তারমধ্যে বিষয়টি একটি সুনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে যাবে। অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে যে, যে আন্দোলনটি শান্তিপূর্ণ ছিল হঠাৎ সেটি সাংঘর্ষিক অবস্থার মুখোমুখি গেল কেন?
ঢাকার ডিএমপির বা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বলেছেন যে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ছাত্রদের ঘরে ফেরা উচিত এবং লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়া উচিত। পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত মানতে এবং কার্যকর করতে বাধ্য। তাই বুধবার পর্যন্ত তারা আন্দোলনে কোনো বাধা দেয়নি। কিন্তু বুধবার সুপ্রিম কোর্ট হাই কোর্টের অর্ডারের ওপর স্টে অর্ডার দিয়েছে। সুতরাং এখনকার পরিস্থিতি হলো, এখন আর দেশে চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে কোনো কোটা নেই। এক মাসের জন্য সুপ্রিম কোর্টের স্টে অর্ডার এসেছে। এক মাস পর সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টির বিস্তারিত শুনানি করবে। তখন ছাত্ররা যদি মনে করে তাহলে তারা তাদের উকিল দিয়ে তাদের বক্তব্য পেশ করতে পারে। এরপর উচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত বা আদেশ দেবে সেটি হবে ফাইনাল। তার আগে রাস্তা অবরোধ বা অন্য যে কোনো আন্দোলন পুলিশ এ্যালও করবে না।
অন্যদিকে ছাত্রলীগও অকস্মাৎ আজ বিকাল ৩ টার সময় থেকে রণমূর্তি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে ছাত্রলীগ দুই একটি হলে বাধা দিয়েছিল। মনে হয় আওয়ামী লীগ থেকে তাদেরকে থামিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্ররা বলছে যে কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ২০১৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র আন্দোলনের মুখে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, শুরুতে এবং ২০১৮ সালে উভয় ক্ষেত্রেই নির্বাহী আদেশে কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। আবার নির্বাহী আদেশেই কোটা সিস্টেম বাতিল করা হয়। এবারও ছাত্ররা নির্বাহী বিভাগেই আবেদন করেছে কোটা সংস্কারের জন্য। যেটি সম্পূর্ণরূপে নির্বাহী বিভাগের বিষয় সেখানে হঠাৎ করে কোত্থেকে বিচার বিভাগকে জড়িত করা হলো? সকলেই জানেন যে, কয়েক ব্যক্তি গত জুন মাসে ২০১৮ সালের কোটা ব্যবস্থা বাতিলের আদেশকে রহিত করার আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন করে। হাইকোর্ট ঐ রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের কোটা ব্যবস্থা বাতিলের পরিপত্রকে রহিত করে। তখন হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ আপিল বিভাগে অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। সুপ্রিম কোর্ট বলে যে এই মুহূর্তে তারা কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পেলে তারা বিষয়টি বিচার করবেন। অন্যকথায়, সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তে হাই কোর্টের রায়ই বহাল থেকে যায়। তখন ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেন।
ছাত্রদের আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল। তারা বারবার বলে এসেছেন যে, বাংলাদেশের হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট অর্থাৎ উচ্চ আদালতকে তারা সম্মান করেন। এখনও তারা সম্মান দেখিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের কথা হলো, বিচার বিভাগ এমন একটি বিষয়ে কেন জড়িত হতে যাচ্ছে যেটি সম্পূর্ণ নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ার?
এখানে আরেকটি কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও কোটা সিস্টেম সম্পর্কে একটি শব্দও লেখা নেই। যেটা রয়েছে সেটা হলো অনুন্নত এলাকা এবং প্রতিবন্ধীদের স্বার্থ সরকার যেন সংরক্ষণ করেন। এ ব্যাপারে ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা বলেন যে প্রতিবন্ধী এবং অনগ্রসর এলাকার জন্য যদি কোনো কোটা দিতে হয় তাহলে তাদের আপত্তি নাই।
তারা একথাও বলছেন যে, সরকারের তরফ থেকে এমনভাবে আন্দোলনের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে যেটা শুনলে মনে হবে যে ছাত্র আন্দোলন বুঝি মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে। কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করে এবং মুক্তি যোদ্ধাদেরকে সমাজের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে মনে করে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৫৪ বছর আগে। তাদেরকে ভাতা দেওয়া হলে তাদের কোনো আপত্তি নাই। দেশে মোট সরকারি চাকরির সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষের কাছাকাছি। এই ২০ লক্ষ চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান এবং প্রতিবন্ধীদের কোটা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি হতে পারে না। আন্দোলনকারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার থেকে অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর ঐ পরিবার থেকে একজন কোটার অধীনে চাকরি পেতে পারেন। কিন্তু তাই বলে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিদেরকেও চাকরি দিতে হবে, সেটা কেউ মেনে নিতে পারেন না। এটি কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। এই পটভূমিতে এখন পুলিশ ও ছাত্রলীগ একদিকে এবং অন্যদিকে হাজার হাজার ছাত্র মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে।
এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্য সমাপ্ত চীন সফর প্রসঙ্গ। সকলেই জানেন যে, ৮ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর করার কথা ছিল। কিন্তু ৮ জুলাই চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে পৌঁছার পর শেখ হাসিনা নাকি জানান যে, তিনি ১১ জুলাই নয়, ১০ জুলাই অর্থাৎ নির্ধারিত সফরসূচীর ২৪ ঘন্টা আগেই দেশে ফিরতে চান। তার সফর সংক্ষেপ করার খবরটি এতই আকস্মিক ছিল যে, এই সফর সংক্ষিপ্ত করা নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমে নানা রকম জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেন যে, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদেরও প্রধানমন্ত্রীর টিমের সফর সঙ্গী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রধানমন্ত্রীকে সফর কাটছাঁট করতে হয়েছে।
যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী তার ১৯৬ জন সফর সঙ্গী নিয়ে ১০ জুলাই রাত সাড়ে ১২ টায় ঢাকায় ফিরে এসেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তার চীন সফরে বাংলাদেশ কী পেলো? প্রশ্নটা আরো বেশি করে এজন্য উঠেছে যে, তার যাওয়ার ৩/৪ দিন আগে থেকেই প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে ফলাও করে খবর প্রকাশ করা হয়েছে যে, ২০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ২ হাজার কোটি ডলারের একটি প্যাকেজ তথা আবেদন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী চীন যাচ্ছেন। এই ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াও দেশে বর্তমানে বিরাজমান রিজার্ভ সংকট মোচনের জন্য আরো ৫ বিলিয়ন ডলারের সমান চীনা মুদ্রা ইউয়ান এবং বাজেট সাপোর্ট হিসেবে আরও ২ বিলিয়ন ডলারের সমান ইউয়ান প্রদানের জন্যও বাংলাদেশ প্রস্তাব রেখেছে।
১১ জুলাই বৃহস্পতিবার বিভিন্ন পত্র পত্রিকা এবং সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেল যে, ২০ বিলিয়ন ডলার তো দূরের কথা, এমনকি ৫ বা ২ বিলিয়ন ডলারও দূরের কথা, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বাংলাদেশকে ১ বিলিয়ন ইউয়ান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ১ বিলিয়ন ইউয়ান হলো ১ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হলো ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার সমান। অর্থাৎ বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল ৫ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৬৫ হাজার কোটি টাকা রিজার্ভ সংকট মোচনের ঋণ হিসেবে। সেখানে ওয়াদা করা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।