স্মরণকালের ইতিহাসে সড়কে এত পানি জমতে দেখেননি রাজধানীবাসী। আগের বৃষ্টিগুলোতে হাঁটু সমান পানি জমলেও গতকালের বৃষ্টিতে অনেক স্থানে কোমর সমান পানি জমে যায়। প্রধান প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সব সড়কেই ছিল জলাবদ্ধতা। অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি কোনো এলাকাই জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায়নি। আগের বৃষ্টিগুলোতে যে সড়কে পানি জমেনি এবার সেসব সড়কেও হাঁটুপানি জমতে দেখা যায়। অনেক স্থানে দোকানে-অফিসে পানি ঢুকে মালপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। বাসাবাড়িতেও পানি প্রবেশ করেছে। কোমর সমান পানির মধ্যে দিয়ে গাড়ি চললেই নদীর মতো ঢেউ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এসব সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে রিকশা, গাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। মোটরসাইকেল, সিএনজি, প্রাইভেট কার, মাইক্রো বাসসহ বিভিন্ন ধরনের কয়েক শ’ গাড়ি ইঞ্জিনে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে যেতে দেখা যায়। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ ছিল। বিভিন্ন কাজে যারা রাস্তায় বের হয়েছেন তাদেরকেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। বিশেষ করে নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির মধ্যে চরম ভোগান্তির মুখে পড়েন। অনেক সড়কে গাছ ভেঙে পড়ে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বৃষ্টির পর পানি অপসারণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু তার পরও সকালের বৃষ্টিতে সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা রাত পর্যন্তও বেশির ভাগ সড়কে থাকতে দেখা গেছে। গতকাল পুরো রাজধানীই ছিল পানিতে থইথই।
গতকাল ভোরে মানুষ যখন সূর্যের আলোর অপেক্ষায় ছিল, তখন আলোর পরিবর্তে আকাশজুড়ে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা। এরপরই শুরু হয় অঝোরধারায় বৃষ্টি। একটানা দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে এ বৃষ্টি। আবহাওয়াবিদ মো: তরিফুল নেওয়াজ কবির জানিয়েছেন, গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় একটানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বহু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিল, কমলাপুর, দৈনিকবাংলা, বায়তুল মোকাররম, তোপখানা রোড, মৎস্যভবন, সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, নয়াপল্টন, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ মোড়, শাহজাহানপুর, রাজারবাগ, ফার্মগেট, মগবাজার, কাওরানবাজার, গ্রীনরোড, প্রগতি সরণী, রামপুরা, বাড্ডা, খিলক্ষেত, নিউমার্কেট, ধানমন্ডির রাপা প্লাজা, মোহাম্মদপুর, মিরপুরের বিভিন্ন সড়ক, গুলশান, বনানী, নিকেতন, বারিধারা, পান্থপথ, সংসদ ভবন, পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ মোড়, বংশাল, নিমতলীর টোয়েনবি সার্কুলার রোড, আরকে মিশন রোডসহ বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সর্বত্রই শুধু পানি আর পানি। রাস্তা দেখা মিলছে নদীর ঢেউ। আরামবাগে প্রায় গলা সমান পানিতে রিকশা, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল তলিয়ে যাচ্ছে। ফকিরাপুল-নয়াপল্টনে হাঁটুসমান পানি। শাজাহানপুর-রাজারবাগ পুলিশ লাইন এলাকায় রাস্তায় গাড়ি চললেই পানির ঢেউ ফুটপাথে আছড়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় ফুটপাথ তলিয়ে গেছে। এতে মানুষ ফুটপাথ দিয়েও হাঁটতে পারছে না। বিকেল ৫টার দিকে শাজাহানপুর থেকে ফকিরাপুল-আরামবাগ হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত আসতে সড়কে অসংখ্য মোটরসাইকেল, সিএনজি ও প্রাইভেট কার নষ্ট হয়ে পড়তে থাকতে দেখা যায়।
প্রাইভেট কার চালক শাহিন আলম জানান, তিনি মতিঝিল যাওয়ার জন্য বাসাবো থেকে যাত্রী নিয়ে চলা শুরু করেন। কিন্তু আরামবাগে ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বিকল হয়ে যায়। মতিঝিল এজিবি কলোনি বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, আগে বড় বৃষ্টি হলেও আমাদের সড়কে পানি জমত না। কিন্তু আজকে আমাদের রাস্তায় হাঁটুপানি জমেছে। দোকানে পানি ঢুকে মালামাল ভিজে গেছে। এসব মালামাল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। স্মরণকালে ঢাকায় এত পানি জমতে দেখিনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড, নবোদয় হাউজিং এলাকায় জলাবদ্ধতায় জনভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সকাল পৌনে ৮টা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে রামচন্দ্রপুর খাল ভরে যায়। মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের চায়ের দোকানি ওবায়দুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা পর খাল ভরে পানি ওয়াকওয়েতে চলে আসছে। আস্তে আস্তে পানি বাড়তেছে। একই এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, এই এলাকায় এক কাঠা জমির দাম এক কোটি থেকে সোয়া কোটি টাকা। কিন্তু অবস্থা দেখেন! বৃষ্টি হইলেই রাস্তায় পানি উঠে যায়। খাল ভরে পানি রাস্তায় চলে আসছে। রাস্তার পাশের দোকানেও পানি ঢুকছে।
বৃষ্টিপাতে ডুবেছে রাজধানীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানঘেরা এলাকা নিউমার্কেটও। নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে শুরু করে নীলক্ষেত পর্যন্ত সড়কে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন রাস্তার পার্শ্ববর্তী অপেক্ষাকৃত নিচু ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। বৃষ্টির পানি উপচে সড়কের সব পানি প্রবেশ করে মার্কেটের ভেতর। ফলে দোকানে রাখা শাড়ি, কাপড়, বই, জুয়েলারিসহ অন্যান্য সব কিছুই ভিজে যায়। এমন অবস্থায় সব মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
শাকিল নামের এক দোকান কর্মচারী বলেন, দোকানের নিচে যত কাপড় রাখা ছিল বেশির ভাগই ভিজে গেছে। সব কাপড় বাসার ছাদে নিয়ে শুকাতে হবে। পানি এখনো কমেনি। কমার পর দোকান খুললে ভেতরের ক্ষয়ক্ষতি আরো বোঝা যাবে।
আসিফ বিল্লাহ নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, বাইরে ফুটপাথে যেসব জিনিস আগের রাতে রেখে গিয়েছিলাম, তার সবই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের। এগুলো রোদে শুকিয়েও ঠিক করা যাবে না। এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।
নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা: দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, সবগুলো দোকানের ভেতরেই এখন এক ফুট পরিমাণ পানি। বইপত্র, কাপড়, তৈজসপত্র, জুয়েলারি সব কিছুই পানিতে ভিজে গেছে। আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল, যা টাকার অঙ্ক দিয়ে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। দোকানের ডেকোরেশনের যে সব বোর্ড ব্যবহার করা হয় সেগুলো যদি পানিতে অল্প ভিজে তাহলে পুরোটাই পরিবর্তন করতে হয়। আজ দীর্ঘ সময় ধরে সেসব বোর্ডসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পানিতে ভিজছে। ভেতরে কী অবস্থা হয়েছে, তা পানি নামলে বলা যাবে।
বারবার পরিষ্কার করার পরও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারে সচেতনতার অভাবে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যায় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, প্রতি মঙ্গলবার মার্কেটের ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়। এরপর সবাই আবার বোতল, প্লাস্টিকের কাপ, পলিথিন এগুলো ফেলে ড্রেন বন্ধ করে দেয়। ঢালাওভাবে সরকার ও সিটি করপোরেশনকে দোষ দেয়া যাবে কিন্তু আমাদের নিজেদের অবস্থা কী সেটাও পর্যালোচনা করা উচিত। যত দিন পর্যন্ত নিজেরা সচেতন না হবো তত দিন এমন অবস্থার মুখোমুখি হতেই হবে। আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে সেটি টাকার অঙ্ক দিয়ে প্রকাশ করার মতো নয়। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতেও কয়েক দিন সময় লাগবে। একই সাথে মার্কেটের ভেতরের পানি নিষ্কাশনের জন্য অতিরিক্ত পাম্প চালানো হয়েছে।
নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে শরিফুল ইসলাম নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ঢাকা এখন ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হচ্ছে। এ দিকে জলাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে রিকশাচালকরা স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া চেয়ে বসছেন বলে কয়েকজন জানিয়েছেন।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গতকাল সকাল থেকেই কাজ শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে নালার মুখে থাকা পলিথিনসহ যেসব বাধা ছিল, তা দূর করার চেষ্টা করে। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন করতে পারেনি তারা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, ভারী বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে পাঁচ হাজারের অধিক পরিচ্ছন্নতা কর্মী। এ ছাড়াও ১০টি অঞ্চলে কাজ করছে ১০টি কুইক রেসপন্স টিম। প্রতিটি কুইক রেসপন্স টিমে ১০ জন কর্মী রয়েছে। জলাবদ্ধতা দ্রুত নিরসনের জন্য কল্যাণপুরে ডিএনসিসির পাঁচটি পাম্প সকাল থেকে একযোগে কাজ করছে। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, জলাবদ্ধতা হওয়ার পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও প্রকৌশলী বিভাগের ১০০টি টিম মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। কমলাপুর টিটি পাড়া পাম্প স্টেশনে ৫ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি বড় পাম্প এবং ৫ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি ছোট পাম্প সচল রয়েছে। ধোলাইখাল পাম্প স্টেশনে ৭.৫ কিউমেক ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি পাম্প সচল রয়েছে; অর্থাৎ বড় ৪টি ও ছোট ৩টি পাম্প মিলিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ২৫ হাজার ৪২৫ লিটার পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে। এছাড়া, হাতিরঝিল স্লুইস গেট চালু রয়েছে।